যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় ঋণের সীমা বৃদ্ধির বিষয়ে একমত হতে পারছে না হোয়াইট হাউস এবং কংগ্রেসের প্রতিনিধি পরিষদ নিয়ন্ত্রণকারী রিপাবলিকান পার্টি। প্রশ্ন উঠছে, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশটি যদি জাতীয় ঋণের সীমা ৩১ দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন ডলার থেকে বাড়াতে না পারে, তাহলে কী ঘটতে পারে।
বিবিসির খবরে বলা হচ্ছে, ঋণের সীমা বৃদ্ধি করতে না পারলে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল সরকার বিভিন্ন দায় পরিশোধ করতে পারবে না, তা এখন সবাই কমবেশি জানেন। কিন্তু অন্যান্য দেশের ওপর তার কী প্রভাব পড়বে, এবার তা দেখে নেওয়া যাক।
অর্থনীতির গতি কমে যাবে
ঋণের সীমা বৃদ্ধি করতে না পারলে যুক্তরাষ্ট্র কি ঋণখেলাপি হয়ে যাবে, এ বিষয়ে বিবিসি যত বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলেছে, তাঁরা সবাই বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ঋণখেলাপি হবে বলে তাঁরা মনে করেন না।
বিনিয়োগ ব্যাংক পানমুরে গর্ডনের প্রধান অর্থনীতিবিদ সাইমন ফ্রেঞ্চ বলেন, ‘শেষমেশ যুক্তরাষ্ট্র যদি খেলাপি হয়, তাহলে বৈশ্বিক আর্থিক সংকট অনেকটা টি পার্টির মতো হয়ে যাবে।’ ২০০৮ সালের আর্থিক সংকটের কথা মাথায় রেখেই তিনি এ কথা বলেন। টি পার্টি একটি রক্ষনশীল রাজনৈতিক আন্দোলন, যার শুরু ২০০৯ সালে। এর প্রবক্তারা কর কমানো এবং জাতীয় ঋণ ও ফেডারেল বাজেট কমিয়ে আনার মাধ্যমে সরকারের খরচ হ্রাস করার পক্ষপাতি।
সাইমন ফ্রেঞ্চ আরও বলেন, ঋণের সীমা বাড়াতে না পারলে যুক্তরাষ্ট্র সরকার বেশি দিন আর ভাতা ও অন্যান্য প্রতিশ্রুতি বাবদ অর্থ পরিশোধ করতে পারবে না। সেই বাস্তবতায় মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাবে।
হোয়াইট হাউস কাউন্সিল অব ইকোনমিক অ্যাডভাইজার্সের হিসাব অনুসারে, সরকার ঋণের সীমা বৃদ্ধির বিষয়ে দীর্ঘমেয়াদি ঐকমত্যে পৌঁছাতে না পারলে অর্থনীতি ৬ দশমিক ১ শতাংশ হারে সংকুচিত হতে পারে।
কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের কুইনস কলেজের প্রেসিডেন্ট অর্থনীতিবিদ মোহাম্মদ আল-ইরিয়ান বলেছেন, ঋণখেলাপি হলে যুক্তরাষ্ট্র মন্দার কবলে পড়বে। সে ক্ষেত্রে অন্যান্য দেশও প্রভাবিত হবে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র অনেক দেশেরই গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য অংশীদার। মন্দার কবলে পড়লে যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের কেনাকাটা কমে যাবে। ফলে যুক্তরাষ্ট্র যেসব দেশের রপ্তানির বড় বাজার, সেসব দেশের রপ্তানি কমে যাবে।
বন্ধকি ঋণের সুদহার বাড়তে পারে
যুক্তরাষ্ট্রের ঋণের সীমা বাড়াতে না পারলে বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি অন্যান্য দেশের বন্ধকি ঋণের সুদও বাড়তে পারে। এতে বাড়তে পারে বেকারত্ব। বিষয়টি হলো, সরকার ঋণ নিতে চাইলে বাজারে বন্ড ছাড়ে, যুক্তরাষ্ট্রে যা ট্রেজারি বন্ড নামে পরিচিত। বিনিয়োগকারীরা বন্ড কিনলে এর বিনিময়ে সরকারের কাছ থেকে সুদ নেয়।
মার্কিন সরকার ঋণ পরিশোধ করতে না পারলে বিনিয়োগকারীরা ভাবতে পারেন, যুক্তরাষ্ট্র ঋণখেলাপি হলে যুক্তরাজ্য বা অন্যান্য দেশ কেন হবে না। তখন তারা বন্ডের সুদহার বাড়াতে চাপ দেবে। এতে সরকারের পক্ষে ঋণ করা যেমন ব্যয়বহুল হবে, তেমনি ব্যক্তির পক্ষেও ব্যয়বহুল হবে।
গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ক্যাপিটাল ইকোনমিকসের যুক্তরাষ্ট্র-বিষয়ক প্রধান অর্থনীতিবিদ অ্যান্ড্রু হান্টার বিবিসিকে বলেন, ‘অনেক ক্ষেত্রেই যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি ঋণ বিশ্বের আর্থিক খাতের মৌলভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হয়। সাধারণত যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি ঋণ বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ সম্পদ হিসেবে পরিচিত এবং বিশ্বের অন্যান্য আর্থিক সম্পদের মূল্য এর ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়।’
অ্যান্ড্রু হান্টার আরও বলেন, ভালো খবর হলো যুক্তরাষ্ট্র খেলাপি হলে নির্দিষ্ট কোনো দেশ অরক্ষিত হয়ে পড়বে, তা নয়। খারাপ খবর হলো, যুক্তরাষ্ট্রের খেলাপি হওয়ার ধাক্কায় বিশ্ব অর্থনীতি টালমাটাল হতে পারে।
দাম বাড়তে পারে
মার্কিন ডলার বিশ্বের রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে বহুল ব্যবহৃত। জ্বালানি তেল ও গমের মতো অনেক গুরুত্বপূর্ণ পণ্য বিশ্ববাজারে ডলারে কেনাবেচা হয়। যুক্তরাষ্ট্র খেলাপি হলে ডলারের দাম পড়ে যেতে পারে। এটা আমদানিকারী দেশগুলোর জন্য সুখবর, কিন্তু সেই পরিস্থিতিতে বিনিয়োগকারীরা পণ্যমূল্য নির্ধারণে বিপাকে পড়বেন।
সেই সঙ্গে বিনিয়োগকারীরা ভাববেন, যুক্তরাষ্ট্র খেলাপি হয়ে গেছে, এরপর জাপান নাকি যুক্তরাজ্য। তাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়বে। সাইমন ফ্রেঞ্চ বলেন, এ পরিস্থিতিতে বিনিয়োগকারীরা পণ্যের দাম বাড়িয়ে পুনর্নির্ধারণ করবেন—অর্থনীতির পরিভাষায় যাকে বলে তাঁরা ঝুঁকি প্রিমিয়াম যোগ করবেন। এতে গমের মতো পণ্যের দাম অনেকটাই বেড়ে যাবে।
বাস্তবতা হলো, আটা ও জ্বালানির দাম আরও বেড়ে গেলে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় অনেকটাই বেড়ে যাবে।
পেনশন কমে যাবে
যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ারবাজারে বিশ্বের প্রায় সব দেশের বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ আছে। অনেক দেশের পেনশন তহবিলের অর্থ এ বাজারে বিনিয়োগ করা হয়েছে। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এ জে বেলের পরিচালক রাস মোল্ড বিবিসিকে বলেন, বৈশ্বিক স্টক মার্কেটের যা বাজারমূল্য, তার প্রায় ৬০ শতাংশই যুক্তরাষ্ট্রের।
সে জন্য বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ারবাজার ওঠানামা করলে বিশ্বের অনেক দেশের পেনশন তহবিলের মূল্য বাড়ে বা কমে, সেটা মানুষ জানুক বা না জানুক। যুক্তরাষ্ট্রের সরকার খেলাপি হলে সে দেশের শেয়ারবাজারও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তবে তা হলেই যে আকাশ ভেঙে পড়বে, তা নয়।
২০১১ সালেও এখনকার মতো অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল। তখন যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ারবাজার ধসে গিয়েছিল। তবে সেই ভীতি তেমন একটা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি, শেয়ারসূচক পড়ে গেলেও দ্রুত-ই তা ঘুরে দাঁড়ায়।
রাস মোল্ড বলেন, এবারও সে রকম কিছু একটা ঘটবে। তবে যাঁরা এখন পেনশনের অর্থ তুলবেন, তাঁরা কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন। কিন্তু যাঁরা কিছুটা সময় পর তুলবেন, তাঁরা ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবেন।