সাদিক মাহবুব ইসলাম : আরব বসন্তের উত্তাল সময়ে ২০১১ সালে বাশার আল-আসাদের শাসনে বিক্ষুদ্ধ গণতন্ত্রপন্থী জনগণের বিক্ষোভের ওপর নৃশংস ক্র্যাকডাউনের পর শুরু হয়েছিল যে গৃহযুদ্ধ, সেটি একুশ শতকের সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক এবং জটিল সংঘাতগুলোর একটিতে পরিণত হয়েছে। এ যুদ্ধ প্রায় পাঁচ লাখের বেশি সিরিয়ানের জীবন কেড়ে নিয়েছে, লক্ষ লক্ষ মানুষকে বাস্তুচ্যুত করেছে এবং ভয়াবহ মানবিক সংকট তৈরি করেছে। এটি আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক শক্তির প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।
সিরিয়ার সংঘাতের সবচেয়ে প্রভাবশালী খেলোয়াড়দের মধ্যে রয়েছে সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত। আসাদের সবচেয়ে বড় মিত্র ইরানের আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী এই দুটি উপসাগরীয় আরব রাষ্ট্র। এই অঞ্চলে ইরানের প্রভাব রোধ করার আশায় উভয় দেশই বিভিন্ন বিদ্রোহী গোষ্ঠীকে আর্থিক, রাজনৈতিক এবং সামরিক সহায়তা প্রদান করেছে। তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে মধ্যপন্থী বিদ্রোহীদের সমর্থন করার একটি কর্মসূচিও চালিয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত উভয়ই সিরিয়ার বিষয়ে তাদের পথ পরিবর্তন করে আসাদ এবং তার সরকারের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনরুদ্ধারের ইঙ্গিত দিয়েছে।
২০২১ সালের মে মাসে সৌদি আরবের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এক দশকের মধ্যে প্রথমবারের মতো দামেস্কে যান এবং আসাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তারপর এ বছরের ১৯ মে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ আরব লিগের শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে জেদ্দায় সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের সাথে দেখা করেন। বছরের পর বছর আটকে থাকার পর লিগে সিরিয়ার সদস্যপদ ফিরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তের পর সৌদি আরব বাশার আল-আসাদকে সম্মেলনে যোগ দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিল।
২০১১ সালের পর এই প্রথম আসাদ আরব লিগের শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন। লক্ষাধিক বাস্তুচ্যুত সিরিয়ানদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কোনো পূর্বশর্ত ছাড়াই আসাদের আরব লিগে প্রত্যাবর্তন মধ্যপ্রাচ্যে একটি টার্নিং পয়েন্ট। বিরোধী দলের কোয়ালিশন এর প্রতিক্রিয়ায় এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, সিরিয়ার জনগণের বিরুদ্ধে বাশারের ভয়ংকর অপরাধের কারণে তার শীর্ষ সম্মেলনে অংশগ্রহণ নিন্দনীয়।
আসাদকে মোহাম্মদ বিন সালমান উষ্ণভাবে স্বাগত জানিয়েছেন। এ ক্রাউন প্রিন্স ইতোমধ্যে ইরানের সঙ্গে সৌদি আরবের কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করছেন এবং ইয়েমেনে ইরান-সমর্থিত বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সৌদি আরবের প্রক্সি যুদ্ধের অবসান ঘটাচ্ছেন। আসাদ তার প্রথম বৈঠকে সৌদি কর্মকর্তাদের সাথে তিউনিসিয়ার প্রেসিডেন্ট কাইস সাইদের সাথে সাক্ষাৎ করেন — সাইদ তিউনিসিয়ায় ভিন্নমতের বিরুদ্ধে দমন-পীড়ন চালাচ্ছেন। ‘আমরা অন্ধকারের আন্দোলনের বিরুদ্ধে একসঙ্গে দাঁড়িয়েছি,’ এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন আসাদ।
সৌদি আরবের সিরিয়ার পুনর্গঠন এবং যুদ্ধ-পরবর্তী দেশে ভূমিকা রাখার ইচ্ছা আসাদকে অর্থনৈতিক সুযোগ এবং রাজনৈতিক সুবিধা দিতে পারে।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো সৌদি আরব সিরিয়ার বিরোধীদের অর্থায়ন বা অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে, যার মধ্যে দিয়ে তারা স্বীকার করেছে যে আসাদকে অপসারণের জন্য তাদের প্রায় দশকব্যাপী প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। এই পরিবর্তনটি বেশ কয়েকটি কারণকে প্রতিফলিত করে।
এর একটি অর্থ হলো, আসাদ যুদ্ধ থেকে বেঁচে গেছেন এবং ২০১৫ সালে রাশিয়ার সামরিক হস্তক্ষেপ তার পক্ষে হাওয়া ঘুরিয়ে দেওয়ার পরে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে তাকে সরানোর সম্ভাবনা নেই। এই সুযোগে ইরানের সাথে সম্পর্ক উন্নত করতে চায় সৌদি আরব — ইতোমধ্যেই চীনের মধ্যস্থতায় ২০২১ সালের এপ্রিল থেকে সৌদি আরবের সাথে পরোক্ষ আলোচনা চলছে ইরানের। একইসাথে অন্তর্দ্বন্দ্ব, চরমপন্থা এবং দুর্নীতিতে জর্জরিত সিরিয়ার বিরোধীদের অগ্রগতি এবং সমন্বয়ের অভাব নিয়ে হতাশাও প্রকট।
তবে সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের আসাদকে আলিঙ্গন করার অর্থ এই নয় যে তারা সিরিয়ার বিদ্রোহীদের সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করেছে বা তার বৈধতাকে সমর্থন করেছে। তারা এখনও কিছু বিরোধী দলের সঙ্গে যোগাযোগ ও সমর্থন ধরে রেখেছে। দেশ দুটি জাতিসংঘ-সমর্থিত শান্তি প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে আসাদকে রাজনৈতিক সংস্কার বাস্তবায়ন এবং মানবাধিকারকে সম্মান করার দাবিও অব্যাহত রেখেছে।
পাশাপাশি সৌদি আরব-সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রত্যাশা, আসাদ সিরিয়া থেকে পাচার হওয়া মাদকদ্রব্যের ব্যবসা রোধ করবেন। এ ব্যবসা আসাদের সরকারের জন্য আয়ের একটি লাভজনক উৎস হয়ে উঠেছে। সিরিয়ার অভ্যন্তরে আসাদের শাসন এখনো ভঙ্গুর, দেশটির উত্তরের বিশাল এলাকা তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে এবং লক্ষ লক্ষ শরণার্থী সিরিয়ার আশেপাশের দেশগুলোতে তার শাসনের বিরোধিতা করছেন।
কিন্তু এটা স্পষ্ট যে সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত সিরিয়ার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তাদের প্রত্যাশা এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষায় লাগাম টেনে ধরেছে। তারা আর আসাদকে উৎখাত করতে বা শাসনের মৌলিক পরিবর্তন চায় না। পরিবর্তে তাদের লক্ষ্য সিরিয়ার সীমানার মধ্যে আসাদের ক্ষমতা এবং প্রভাব বজায় রাখা এবং তাকে ইরান বা রাশিয়ার পুতুল হওয়া থেকে বিরত রাখা। তারা ইরান এবং অন্যান্য আঞ্চলিক খেলোয়াড়দের সঙ্গে তাদের আলোচনায় দর কষাকষির তাস হিসেবে আসাদকে ব্যবহারের চেষ্টা করছে।
সিরিয়ার সংঘাতের জন্য এই পরিবর্তনের প্রভাব মিশ্র। একদিকে এটি উভয় পক্ষের সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর জন্য বহিরাগত সমর্থন সীমিত করে সহিংসতা ও রক্তপাত হ্রাস করতে পারে। পাশাপাশি এটি বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে সংলাপ এবং কূটনীতির জন্য আরও জায়গা তৈরি এবং মানবিক সহায়তা এবং পুনর্গঠন প্রচেষ্টাকে সহজ করার সম্ভাবনা রাখে।
অন্যদিকে এটি একটি সত্যিকারের রাজনৈতিক উত্তরণের সম্ভাবনাকে দুর্বল করে দিতে পারে। সিরিয়ার জনগণের স্বাধীনতা, মর্যাদা এবং ন্যায়বিচারের আকাঙ্ক্ষাও খুব একটা গুরুত্ব পাবে না এ পরিবর্তনে। এটি আসাদের স্বৈরাচারী শাসন এবং মানবতার বিরুদ্ধে তার অপরাধের জন্য দায়মুক্তিও আটকাতে পারে।
সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত সিরিয়ার বিদ্রোহীদের সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ না করলেও তারা সিরিয়ার যুদ্ধে তাদের অবস্থান উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তন করেছে। তারা আসাদের টিকে থাকাকে মেনে নিয়েছে এবং তাকে মোকাবিলা করার পরিবর্তে তার সাথে জড়িত থাকার চেষ্টা করেছে। দেশ দুটি তাদের নৈতিক অবস্থান বা আদর্শগত পছন্দের পরিবর্তে তাদের বাস্তববাদী স্বার্থ এবং কৌশলগত সুবিধাকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছে।
উপসাগরের আরেক প্রভাবশালী দেশ কাতারেরও সিরিয়া বিষয়ে মাথাব্যথা রয়েছে। ২০১১ সালে গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে কাতার সিরিয়ার বিদ্রোহীদের অন্যতম প্রধান সমর্থক। কাতার বিভিন্ন বিদ্রোহী গোষ্ঠীকে অস্ত্র, অর্থ, প্রশিক্ষণ এবং রাজনৈতিক সমর্থন প্রদান করেছে। কাতারের লক্ষ্য ছিল প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করতে সাহায্য করা।
তবে সিরিয়ায় কাতারের ভূমিকা বেশ কিছু কারণে জটিল হয়েছে। প্রথমত, কাতার অন্যান্য উপসাগরীয় রাষ্ট্র, বিশেষ করে সৌদি আরব থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্মুখীন হয়েছে। দ্বিতীয়ত, খুব কট্টরপন্থী বা চরমপন্থী হিসেবে বিবেচিত কিছু বিরোধী দলকে সমর্থন করার জন্য কাতার সমালোচিত হয়েছে।
সিরিয়ার বড় অংশ বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়া বা স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলে পরিণত হওয়ার কারণে দীর্ঘদিন ধরে মনে হচ্ছিল আসাদ ক্ষমতার ওপর তার দখল হারাচ্ছেন। কিন্তু মিত্র রাশিয়া এবং ইরানের সহায়তায় আসাদ যুদ্ধক্ষেত্রে সামাল দিয়ে ওঠেন। তাকে কূটনৈতিক বা সামরিকভাবে ক্ষমতাচ্যুত করার বেশ কয়েকটি প্রচেষ্টা থেকেও বেঁচে যান তিনি।
জেদ্দায় আরব লিগের শীর্ষ সম্মেলনে আরব প্রতিবেশীদের কাছ থেকে উষ্ণ অভ্যর্থনা বা মোহাম্মদ বিন সালমানের নেতৃত্বে আরব নেতাদের মধ্যপ্রাচ্যের পুনর্গঠন এবং ইরানের প্রভাব মোকাবিলায় একটি বাস্তববাদী অংশীদার হিসেবে আসাদকে গ্রহণের সিদ্ধান্তের কারণে আসাদ এখন সিরিয়ার শাসক হিসেবে নিজের অবস্থানকে আরেকটু পাকাপোক্ত করেছেন।
কিন্তু এসবের মানে এই নয় যে আসাদ যুদ্ধে জয়ী হয়েছেন অথবা শান্তি সন্নিকটে। আসাদ যদি বেশিরভাগ এলাকা বিদ্রোহীদের কাছ থেকে পুনরুদ্ধার করতেও পারেন, তবুও তিনি শাসনের ক্ষেত্রে অনেক চ্যালেঞ্জ এবং হুমকির সম্মুখীন হবেন। নিষেধাজ্ঞা, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনায় বিপর্যস্ত এক বিধ্বস্ত অর্থনীতির সঙ্গে তাকে মোকাবিলা করতে হবে। তাকে একটি ছিন্নভিন্ন অবকাঠামো পুনর্নির্মাণ করতে হবে এবং সহিংসতা, বাস্তুচ্যুতি এবং দারিদ্র্যের কারণে চরমভাবে পর্যুদস্ত জনগণকে মৌলিক পরিষেবা প্রদান করতে হবে। এমনকি বাশার আল-আসাদকে তার মিত্রদের দাবিও পূরণ করতে হবে।
সুতরাং আসাদ যুদ্ধে জয়ী হয়েছেন বা যুদ্ধ শেষ হয়েছে তা ঘোষণা করার সময় আসেনি। সিরিয়ার পরিস্থিতি এখনো অস্থির এবং অপ্রত্যাশিতই রয়ে গেছে। আরব লিগের শীর্ষ সম্মেলনকে আসাদের অপরাধের বৈধতা বা তার প্রতিবেশীদের সাথে তার সম্পর্কের স্বাভাবিকীকরণ হিসাবে দেখা উচিত নয়, বরং তাকে অর্থপূর্ণ সংলাপ এবং সংস্কারে জড়িত হওয়ার জন্য চাপ দেওয়ার সুযোগ হিসাবে দেখা উচিত। তবে দিনশেষে আসাদ একটা বিষয় পরিষ্কার করে দিলেন — যথেষ্ট বিদেশি মিত্র থাকলে গণহত্যা চালানোর পরেও ক্ষমতায় টিকে থাকা যায়, এবং একটা সময় পর ঠিকই সবাই স্বৈরাচারকে মেনে নেয়।