Google search engine
প্রচ্ছদমতামতআমেরিকার কবি ওয়াল্ট হুইটম্যান

আমেরিকার কবি ওয়াল্ট হুইটম্যান

তারেক অণু : যে মুক্তচিন্তার অধিকারী, দেশপ্রেমিক, স্বপ্নের ফেরিওয়ালা ও বিপ্লবী জানান দিয়েছিলেন যে দেহ অতি পবিত্র এক জিনিস এবং এর চাহিদাগুলো কবিতায় আনার অতি উপযুক্ত, সেই কবি ওয়াল্ট হুইটম্যান এক সমতার রাজ্যে বাস করেন; মুদি দোকানী থেকে রাষ্ট্রপতি সকলেই তাঁর ভক্ত। ‘লিভস অফ গ্রাস’ তাঁর শ্রেষ্ঠতম সৃষ্টি, যা কিনা তাঁর যুগে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল। কিন্তু শতবর্ষ পরে আজও হুইটম্যানের শব্দেরা ভীষণভাবে সগৌরবে তাদের অস্তিত্ব জানান দেয়, যা নগরের গর্জনের মত, উত্তাল ঢেউয়ের বিস্ফোরণের মতই সজীব ও প্রমত্ত।

ওয়াল্ট হুইটম্যান তাঁর ‘লিভস অফ গ্রাস’এ আহ্বান জানিয়েছিলেন,
‘হে পথিক
তুমি যদি আমার পাশ দিয়ে চলে যাও, এবং আমার সাথে কথা বলার সাধ জাগে
তবে কেন তুমি আমার সাথে কথা বলো না?
এবং কেন আমি তোমার সাথে কথা কইব না?’

আমি কোনো সময়ই শুনি নাই তাঁর আহ্বান। বইয়ের প্রতি তীব্র আকর্ষণ স্বত্বেও হুইটম্যান এবং অন্য কবিদের লেখা কেবল বাধ্য হলেই পড়েছি। কলেজে ইংরেজিতে থার্ড ক্লাস পেয়ে পাশ করেছিলাম, পরে আর কোনোদিনই সাহিত্য ক্লাসের ছায়া মাড়াই নি। ‘লিভস অফ গ্রাস’ এখনো আমার বইয়ে তাকে অক্ষয় হয়ে অবস্থান করছে। সেই পঙক্তিগুলো, যা অনেক বছর আগে হোমওয়ার্ক করার জন্য দাগিয়ে ছিলাম, সেগুলো আমার কাছে দূর বাতিঘরের আলোকশিখার মত দীপ্যমান হয়ে ওঠে, এক অবাক উদাত্ত কণ্ঠ আমি দশদিক থেকে শুনেই পাই, যার উত্তর কোনোদিনই দেওয়া হয় নি।

হুইটম্যান কবিতার জন্য সেই দুর্লঙ্ঘ কাজটিই করেছিলেন, যা সার্ভেন্তেস করেছিলেন উপন্যাসের জন্য, বেখট থিয়েটারের জন্য এবং পিকাসো শিল্পকলার জন্য। কবিতার ভঙ্গী এবং বিষয়বস্ত নির্ধারণের জন্য বিংশ শতাব্দীর মার্কিন কবিরা এবং সারা বিশ্বের অনেক কবিই দিন শেষে হুইটম্যানের উত্তরসূরি। ‘লিভস অফ গ্রাস’ যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি স্কুলেই অবশ্যপাঠ্য এবং ডজনখানেক ভাষায় অনুদিতও হয়েছে।

হুইটম্যানের সন্ধানে আমি লং আইল্যান্ডের ওয়েস্ট হিলের সেই শতাব্দীপ্রাচীন খামারবাড়িতে হাজির হই যেখানে তিনি জন্মেছিলেন। আমি নানা ভাবে জানার চেষ্টারত ছিলাম যে হুইটম্যান কে ছিলেন? আর আমি তাঁর কোন কোন সৃষ্টি থেকে বঞ্চিত ছিলাম?

স্কুলের শিশুরা টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে ১৯৫১ সালে এই বাড়িটি কিনে নিয়ে বুলডোজারের এটিকে মাটির সাথে মিশিয়ে ফেলার পরিকল্পনা নস্যাৎ করে দেয়। এই বাড়ির দরজা আর কড়িকাঠগুলো ওয়াল্ট হুইটম্যান সিনিয়রের নিজ হাতে তৈরি, যিনি মূলত ছিলেন একজন কাঠমিস্ত্রি ও মৌসুমি কৃষক। ওয়াল্ট হুইটম্যানের জন্মসাল ১৮১৯ আসতে আসতেই হুইটম্যান পরিবারের লং আইল্যান্ডে প্রায় ২০০ বছর বসবাসের ইতিহাস রচিত হয়ে গেছে! এই বাড়ির আবহাওয়া ছিল প্রবল দেশ প্রেমে আচ্ছন্ন। ওয়াল্ট হুইটম্যানের ৫ ভাইয়ের মধ্যে তিন জনেরই নাম রাখা হয়েছিল ইতিহাসবিখ্যাত তিন মার্কিন রাষ্ট্রপতির নামে- জর্জ ওয়াশিংটন হুইটম্যান, থমাস জেফারসন হুইটম্যান এবং অ্যান্ড্রু জ্যাকসন হুইটম্যান।

খামাড়বাড়িটা এখন চার লেনের প্রশস্ত হাইওয়ের পাশে, ওয়াল্ট হুইটম্যান মলের উল্টোপাশেই। সেখান ঢুকতেই পাঁচ টিনেজারের সাথে দেখা, যার পিজ্জা খাওয়াতে ব্যস্ত ছিল। ‘তোমরা কি ওয়াল্ট হুইটম্যান সম্পর্কে জানো?’ আমার আচমকা ছুড়ে দেওয়া এই প্রশ্নে তাদের চার জনই জানালো যে তারা শুনেছে হুইটম্যান একজন ‘কুল’ কবি ছিলেন, শুধু একজন ঘাড় নাড়িয়ে বললো ‘আমি ভেবেছিলাম মিস্টার হুইটম্যান এই শপিংমলের মালিক!’

মোটেলে ফেরার পর ভাবলাম আরেকবার কবিতার জগতে ফেরার সময় হয়েছে। গত ৩০ বছরে সেই ফ্রেশম্যান অবস্থায় বাধত্যমূলক ইংরেজি কোর্সের পর কবিতা পাঠের চেষ্টা করেছিলাম মাত্র একবার। ১৯৮৪ সালে আমার খুব পছন্দের এক বন্ধু ভয়াবহ অসুস্থ অবস্থায় ছিল, তার বান্ধবি কবিতার মাঝেই শান্তি খুঁজে পেয়েছিল এবং একটি বিশেষ সংকলন পড়ার দিকে তার ঝোঁক চেপেছিল, যার একটা পৃষ্ঠায় উঁকি দিয়েই আমার খুব পছন্দ হয়ে যায়। পরবর্তী এক সপ্তাহ ধরে সেই কবিতাগুলো পকেটে নিয়েই ঘুরতে থাকি; যদিও কোনো সময়ই কয়েক লাইনের বেশি একটানা পড়া হয় নি।

সেদিন পড়ার জন্য বেছে নিলাম ‘Out of the Cradle Endlessly Rocking’ কবিতাটি, যা সাহিত্যবোদ্ধারা কবির সেরা কাজগুলোর একটা বলে আখ্যা দিয়েছেন-
‘Out of the mocking-bird’s throat,
The music shuttle
Out of the Ninth-month midnight
Over the sterile sands and the fields beyond, where the child ….’

পরের কয়েক পাতায় অজানা কিছু ঘটার, কিছুকে পাবার আশায় আমার চোখ সেঁটে থাকলো, ‘the lilac scent was in the air’ পর্যন্ত আসতে আসতেই রাজ্যের ঘুম আমায় ঘিরে ধরে, আর ‘Low hangs the moon, it rose late’ অবধি আসার পর টিভির রিমোট খোঁজা শুরু করে দেই।

যদিও খানিকটা অপরাধীই মনে হচ্ছিল নিজেকে, কিন্তু টিভি ছেড়ে একটা বেশ ভালো সিনেমাই উপভোগ করলাম সেই রাতে।

যদিও ওয়াল্টের বছর ৪ পুরো হবার আগেই ক’দিন হুইটম্যান পরিবার ব্রুকলিনে চলে যায়, তারপরও লং আইল্যান্ডের নিসর্গের প্রতি তাঁর ভালবাসায় কোনো সময়ই ঘাটতি পড়ে নি, যা তিনি ‘সাগরের সুন্দর, সরল শুয়ে রোদ পোহানো’ বলে উল্লেখ করতেন। তরুণকালে তিনি প্রায়ই এখানে সাঁতার কাটতে, ঝিনুক সংগ্রহের জন্য আর মাছ ধরতে আসতেন। কনি আইল্যান্ডের জনশূন্য সৈকতে একলা হাঁটতে হাঁটতে সাগরের ঢেউয়ের উদ্দেশ্যে শেকসপিয়র আর হোমার আবৃত্তি করতেন ভবিষ্যতের কবি।

তাকে অনুসরণ করে আমি সাগরের বেলাভূমিতে পৌঁছে যাই, এবং খুব সহজেই বুঝে যাই যে কেন তিনি ঢেউদের সাথে কথা বলতেন। ঢেউতরঙ্গ সবসময়ই জীবন, সদাই কথা শোনা ও উত্তর দেবার জন্য মুখিয়েই আছে। যদিও আমাদের মধ্যে খুব কমজনই নির্জন সৈকতে কবিতা পড়ার উদ্দেশ্যে যায়। তরুণ ওয়াল্ট অবশ্যই নিজেকে ও জীবনকে এক অনন্য উচ্চতায় আবিষ্কার করতে পেরেছিলেন খুব শুরুতেই। তাঁর কাছে প্রশ্ন করি, ‘হে কবি, জানাও আমাদের কী সেই আহ্বান যা তুমি শুনতে পেতে? তোমার ভিতরে কিসের স্ফুলিঙ্গ জ্বলে উঠছিল?’

কোনো উত্তর মেলে না!

ওয়াল্ট হুইটম্যানে উপরে পারিবাহিক আবহের প্রভাব ছিল খুব সামান্য। মা মূলত ধর্মীয় বইপত্র পড়তেন। বাবা ছিলেন পোড় খাওয়া শ্রমিক (!) ও মদে আসক্ত। তাদের ৭ সন্তানের মধ্যে ৩ জনই কোনো না কোনো মানসিক সমস্যায় ভুগতেন। বিদ্যালয় তাদের কাছে কোনো সময়ই গুরুত্বপূর্ণ কিছু ছিল না, ওয়াল্ট ১১ বছর বয়সেই স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেন, যদিও সুযোগ পেলেই বই ধার করে পড়তে থাকতেন আরব্য রজনী, জেমস ফেনিমোর কুপার আর স্যার ওয়াল্টার স্কটের উপন্যাসগুলো, যা তাকে করত শিহরিত, উদ্বেলিত।

ওয়াল্টের জীবনে সবচেয়ে বড় ছাপ রেখেছিল প্রতিদিনকার ফেরিযাত্রা, যা ব্রুকলিন আর ম্যানহাটানের মধ্যে চলাচল করত। তাঁর আমলে ফেরিগুলো ফি বছর লক্ষ লক্ষ যাত্রী আনা-নেওয়া করত, ১৯২০ অবধি এই জলযানগুলো চালু ছিল।

ম্যানহাটানের ফেরি ডক থেকে মাত্র কয়েক ব্লক দূরেই ফাওলার আর ওয়েলস নামে দু’জন পরিচিত থাকতেন, যারা মানুষের খুলি দেখে তাদের ব্যক্তিত্ব ও বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কে আভাস দিতেন। ওয়াল্ট বা তাঁর খুলি সম্পর্কে তাদের সিদ্ধান্ত ছিল বন্ধুত্বময় ও সহানুভূতিপ্রবণ, সেই সাথে কিছুটা অলস ও নিখুঁত হবার তৃপ্তির চেষ্টারত।

শুরুর দিকে স্কুলশিক্ষক ও ছাপাখানার শিক্ষানবিশের চাকরি তাঁর জীবনতৃষ্ণা ধরে রাখার মত দৃঢ় না হওয়ায় ফাওলার আর ওয়েলসের কাছেই ওয়াল্ট এক খবরের কাগজের সাংবাদিক ও সম্পাদক হিসেবে কাজ করতেন, লিখতেন অপরাধ, অগ্নিকাণ্ড, স্থানীয় রাজনীতি ও দাসপ্রথা (যা তাঁর ভাষায় ছিল এক ভয়াবহ অপরাধ) নিয়ে, সেগুলো কাজের জিনিস হলেও অমরত্ব পাবার মত কিছু ছিল না। ওয়াল্ট বেশ কিছু ছোট গল্প আর ‘ফ্রাংকলিন ইভান্স’ নামের একটা উপন্যাসও লিখেছিলেন। তাঁর প্রথম দিকের কবিতাগুলো নিউইয়র্কের নানা খবরের কাগজে ছাপা হয়েছিল ‘But where, O Nature, where shall be the soul’s abiding place?’ যেগুলো ছিল বেশ কাঁচা আবেগের ফসল।

বেশ ক’টা খবরের কাগজই তাকে নানা কর্মজনিত বদভ্যাসের কারণে চাকরিচ্যুত করে। এক সহকর্মীর মতে ওয়াল্ট এতটাই অলস ছিল যে তাকে কথা বলানোর জন্য দুইজন ব্যক্তিকে রীতিমত কসরত করতে হত দুই চোয়াল খোলানোর জন্য! আর সেই শ্রমিকদের অবস্থা ও সরকারি দুর্নীতি নিয়ে সোচ্চার থাকাও একটা বড় কারণ। ১৮৪২ থেকে ১৮৪৫ পর্যন্ত এই ৪ বছরেই তাকে নিউইয়র্কের অন্তত ১০টা সংবাদপত্রে কাজ করতে দেখা যায়।

ব্রডওয়ে ছিল নিউইয়র্কের ব্যস্ততম রাস্তা, ফেরির ডক থেকে টানা ৩ মাইল ১৪ নাম্বার স্ট্রিট অবধি যাওয়া এই পথে ভরে ছিল থিয়েটার, ওপেরা, হোটেল, রেস্তোরাঁ, তাঁর মতে এই জায়গা দিয়ে যাবার সময় সাগর সাঁতার কাটার মত অনুভূতি হত।

হুইটম্যান প্রায়ই ওপেরায় যেতেন এবং রোসসিনি, বেল্লিনি, মোজার্ট ও ভার্দির রচিত গান গাইতে পছন্দ করতেন। যদিও তাঁর মূল নেশা ছিল, সেই সব পথিকদের সাথে গল্পে মজে যাওয়া, যাদের কাজের ফাঁকে ফাঁকেও আড্ডার ফুরসৎ ছিল। ব্রডওয়েতে যাবতীয় কোচোয়ান, বুড়ো হাতি আর মোটকা ষাঁড় নামের লোকদের সাথে দিব্যি আড্ডা দিয়ে যেতেন, সেই সাথে ব্রডওয়ের এক প্রান্তে কানাল স্ট্রিটে দমকল অফিসে নিয়মিত যেতেন আলাপের নেশায়।

ইঞ্জিন কোম্পানি ২৪ এবং মি কোম্পানি ৫ এর মাঝামাঝি এক জায়গায় দমকলকর্মীরা অচেনা পথিকদের সাথেও আড্ডায় মেতে উঠত, অন্তত সেই আমলে। আর যেদিন আমি সেখানে গেলাম সেদিন দমকল অফিসের সামনের ফুটপাত ফুল, মোমবাতি, হাতে লেখা শোকবার্তায় ভর্তি ছিল, কারণ আগের সপ্তাহেই দুজন দমকলকর্মী আগুনের সাথে এক মোকাবেলায় নিহত হয় এবং একজন বাজেভাবে দগ্ধ হন।

ডেভিড স্লেইফার নামের এক দমকলকর্মীর সাথে তাদের রান্না ঘরে যাই, চকচকে ঘরটি দেখে একটি বড়সড় পরিবারের থাকার জায়গা মনে হচ্ছিল, যাদের একটি লম্বা বেশ বড় ডাইনিং টেবিল লাগে। সেই দুর্ঘটনার খবর যখন আসে তখন সে ডিনার সাজাচ্ছিল । ডেভিড আমাকে দুই ইঞ্চি পোড়া রবার দেখালো, যা তার এক মৃত সহকর্মীর বুটের টিকে থাকা শেষাংশ। উত্তাপে প্রায় গলে যাওয়া একটা দুমড়েমুচড়ে যাওয়া হেলমেটও ছিল সেখানে।

তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘সাহসী হওয়া বলতে আসলে কী বোঝায়?’

সে উত্তর দিল ‘সেটাই করা যেটা করার জন্য মানুষ তোমার উপর নির্ভর করছে।’

বাহিরে, সেই ফুলদের মাঝে কেউ একজন হুইটম্যানের কবিতা রেখে গেছেন,
‘ I understand the large heart of heroes,
The courage of present time and all times;
… I am the man…
… I suffered …
… I was there.”

ব্রডওয়ের জনসমুদ্রে হুইটম্যানের সন্ধানে ফের সাঁতরে ফিরলাম। ছয় ফুট লম্বা; চওড়া ছাতির অধিকারী। বুটের মধ্যে ঢোকানো ব্যাগি ট্রাউজার। চামড়ার জ্যাকেটের পকেটে ঢোকানো হাত। আত্মবিশ্বাসী। পেশীবহুল ঘাড় আর লোমশ বুক দেখাবার জন্য বোতাম খোলা শার্ট। স্থায়ী সাদা দাড়ি। সদ্য ধোয়া মুখ। বড় পাপড়ির চোখ। এই চোখেরাই ছিল তাঁর আড্ডার যোগের চাবিকাঠি। উনি প্রশ্ন করতেন, মানুষ বিস্ময়ে ভেসে উঠে আকাশনীল চোখের দিকে তাকিয়ে কথা শুনে যেত। সেখানে হাঁটতে হাঁটতে সেই লোকদের প্রতি,যারা সেই রাস্তায় হাঁটার সময় হুইটম্যানের সাথে আড্ডা দিয়েছে, একটা অভূতপূর্ব হিংসা জেগে উঠল।

৩০ বছর বয়সে হুইটম্যান ‘লিভস অফ গ্রাস’ লেখা শুরু করেন সকলের অগোচরেই। আঙ্গুল থেকে ঝরে পরা শব্দপ্রপাতে বাইবেল, ক্ল্যাসিক উপন্যাস, অপেরা, দেশপ্রেম, সাংবাদিক হিসেবে তাঁর অভিজ্ঞতা এবং নিসর্গপ্রেম সবই মিশে যেতে থাকে অপূর্ব ঝঙ্কারে। অনেক মানুষই দুঃখ আর সংগ্রাম থেকেই লেখার উপাদান পান। কিন্তু হুইটম্যানের দিকরেখা ছিল যেটা তাকে অলীক সুখের সন্ধান দিত, সেই মানুষেরা যাদের তিনি নিজের মত করেই আত্নস্থ করেছিলেন। তাঁর কবিতাগুলো আসলে যেকোনো কিছুর থেকেই ছিল তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত, নিজের সঙ্গে নিজের কথোপকথন।

কেন হুইটম্যান হঠাৎ করে নিজের অন্তরের আহ্বান শুনলেন? অধিকাংশ শিল্পীই প্রচুর সংগ্রামের পর ব্যর্থ প্রচেষ্টা উপহার দেন যেখানে ভবিষ্যতের মহত্তর শিল্পের ঝিকিমিকি নজরে আসে। কিন্তু অমরত্বের পথে হুইটম্যানের উত্থান একবারেই অনায়াস অবশ্যম্ভাবী রূপে আসে। তাঁর নিজের কাছেও এর কোনো ব্যাখ্যা ছিল না। পরে একবার বলেছিলেন, ‘আমি সেটাই করেছি, যেটা করেছি কারণ সেটা আমি করেছি’- এটাই সম্পূর্ণ রহস্য। ছবি দেখে বোঝা যায় সেই সময়ে তাঁর চোখেরা অনেক আলোকময়, অনেক উষ্ণতাপূর্ণ ছিল।

প্রায় ৫ বছর পর, ১৮৫৫ সালে, হুইটম্যান ‘লিভস অফ গ্রাস’ প্রকাশ করেন। ৮৩ পাতায় ১২টি কবিতা, যার কিছু কিছু তিনি নিজেই টাইপ করেছিলেন। বইতে কোনো লেখকের নাম ছিল না, বরং নিজের কোমরে হাত দেওয়া একটা ছোট আলোকচিত্র দেন, উল্লাসে কাঁপা । কবির অনুপস্থিতি হুইটম্যানের সেই উপলব্ধিকেই জোরালো করে যে পাতার কণ্ঠ সবখানেই ছড়িয়ে পরে।
হুইটম্যানের আগে তথাকথিত সিরিয়াস কবিতারা ছন্দের কঠোর নিয়ম, আকারে খাঁচা মেনে ঘুরে ফিরেই দুর্দান্ত , রোমান্স নিয়ে লেখা হতো। ‘লিভস অফ গ্রাস’- এর আদি সংস্করণে সেখানে নজর দেওয়া হয়েছে জীবিকা অর্জনের নানা পেশার উপরে- কামার, কাঁচপ্রস্ততকারক, নখের কারিগর, তামার কারিগর, টিনের ঘরামি, খড় কাঁটার মজুর, A song for occupations’ । সেই সাথে দেখানো হয় যে আমেরিকান গণতন্ত্র এক নতুন আলোকিত অদম্য শক্তি-

‘Unscrew the locks from the door!
Unscrew the doors themselves from their jambs!
I speak the password primeval
I give the sign of democracy.”

হুইটম্যানের আশা ও সাহসিকতা সমান্তরাল পথেই চলছিল। তিনি চেয়েছিলেন এই গণতন্ত্রের নাগরিকদের, অথাকথিত আমজনতা যেন ‘লিভস অফ গ্রাস’ তাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ হিসেবেই গ্রহণ করে।

যদিও হতাশার খবরগুলো আসলো অতি দ্রুত, তাঁর মা, যার সাথে ওয়াল্ট তখনো বাস করতেন বইটিকে ‘বেশ এলোমেলো’ হিসেবে গ্রহণ করলেন। এর বিষয়বস্তুর কারণে খুব কম দোকানই বইটি রাখতে রাজি হয়েছিল। হুইটম্যানের মতে দরিদ্ররা ধনীর মতই সমান গুরুত্বপূর্ণ এবং নারী ও পুরুষ সমান! সবচেয়ে আক্রমণাত্নক ছিল সেই যুগে যখন পিয়ানোর পা পর্যন্ত মুড়িয়ে রাখা হতো, তখন তিনি মানবদেহের প্রশংসায় মাতলেন! এক সমালোচকের মতে তিনি এক বিউটিপার্লারে প্রস্রাবের পাত্র নিয়ে হাজির হলেন!’

খুলি যে চরিত্র বোঝার বিদ্যা নিয়ে ওয়াল্টের প্রশংসায় খুশি হয়ে ফাওলার ও ওয়েলস তাদের দোকানে বইটি রাখতে রাজি হন। যদিও বিক্রি খুব অল্প হয়েছিল, কিন্তু তা মোটেও হুইটম্যানকে আশাহত করতে পারে নি। তাঁর ভাই জর্জের মতে তিনি ছিলেন ‘একটা ইটের প্রাচীরের চাইতেও বেশি একগুঁয়ে’।

এর মাঝে হুইটম্যান বইটির এক কপি তখন আমেরিকার প্রধান কবি রালফ ওয়াল্ডো এমারসনের কাছে পাঠান। তাদের কোনোদিন সাক্ষাতও হয় নি, তাদের কোনো পরিচিত বন্ধুও ছিল না, তাই তাঁর কোনো উত্তরের প্রত্যাশা করার কোনো কারণ ছিল না।

অথচ এমারসন ম্যাসাচুসেটসের কনকর্ড থেকে হুইটম্যানকে চিঠিতে লেখেন, ‘আমি কিছুক্ষণ চোখ রগরে নিশ্চিত হয়েছিলাম যে, চারপাশের জগত কোনো ভ্রম নয়! ‘লিভস অফ গ্রাস’ আজ পর্যন্ত আমেরিকায় লেখা সর্বশ্রেষ্ঠ জীবনলব্ধ জ্ঞান ও তীক্ষ্ণ রসবোধের সংমিশ্রণ।

বিনয়ের তোয়াক্কা না করে হুইটম্যান নিজেই বেনামে নিজের বইয়ের আলোচনা লিখে নানা পত্রিকায় পাঠিয়েছিলেন, যার বেশকিছু ছাপাও হয়েছিল, কোনো কোনোটায় লেখা হয়েছিল, ‘অবশেষে একজন মার্কিন পুরুষোত্তম, আরেকটাই বলা হয়েছিল আমরা এক মহান দার্শনিকদের আগমনবার্তা শুনতে পাচ্ছি- হয়তো একজন মহান কবিরও। কিন্তু হুইটম্যান এক অপ্রত্যাশিত কারণেও বেশ নাম করেন, তা হচ্ছে তাকে নিয়ে প্যারোডি করা বেশ সহজ ছিল। যেমন ১৮৫৭ সালে লন্ডনের এক্সামিনার তাঁর আদলে একটি কবিতা প্রকাশ করে,

‘চায়ের কেটলী
৫ কফি চামচ, চিনির পাত্র ও ঢাকনা,
৪টা পিরিচ আর ৬টা কাপ।’

১৮৭৩ সালে ৫৩ বছর বয়সে একটা স্ট্রোকের ধকল সামলে কবি নিউজার্সির ক্যামডেনে ভাই জর্জ ও ভাইয়ের স্ত্রী লুইসার সাথে থাকার জন্য যান। জর্জ তখন ক্যামডেনের নানা যান্ত্রিক কাজকর্মের একজন পাইপ পরিদর্শক ছিলেন। ক্যামডেন তখন ফিলাডেলফিয়ার এক ব্যস্ত শিল্পপ্রধান এলাকা ছিল, যেখানে আরেক হুইটম্যান পরিবারও থাকতো, যারা ১৮৪২ থেলে হুইটম্যান চকলেটের জন্য বিখ্যাত ছিল। আমাদের কবির সাথে তাদের কোনো সাক্ষাৎ হয় নি।

পরবর্তী কয়েক বছর কবির আরো কয়েকটি স্ট্রোকের আক্রমণ হয়, এবং হাঁটাচলাতেও সমস্যা দেখা দেয়। যন্ত্রণাময় যক্ষ্মার সংক্রমণ তাঁর হাড়ে ছড়িয়ে পরে। কাছের টিম্বার ক্রিকের কাছে কবি নিজের সারিয়ে তোলার শপথ নেন। এখন সারিসারি বাড়ি আর রাস্তার মাঝে খালটি প্রায় হারিয়ে গেছে। কিন্তু সেই গন্তব্যে আমি ঠিকই পৌঁছালাম যেখানে হুইটম্যান তাঁর সমস্ত কাপড় দূরে রেখে, কাঁদায় নিজেকে আবৃত করে ওকের নগ্ন গুড়ির সাথে যুঝে প্রশ্ন করছিলেন, ব্যবসা, রাজনীতি, সহমত, প্রেম সব কিছুর সাথে ক্লান্ত হবার পর তুমি যখন দেখ যে কোনোকিছুই পূর্ণ তৃপ্তি এনে দিচ্ছে না, তখন কী থাকে?’

তখন প্রকৃতি থাকে।

সারাজীবনের লেখালেখি থেকে কবি কয়েক হাজার ডলার পেয়েছিলেন। ‘লিভস অফ গ্রাস’- এর কম কাটতিও সেটার উপর সেন্সরের কাচি চালানো কমায় নি! ১৮৮২ সালে বোস্টনের ডিস্ট্রিক্ট অ্যার্টনি তাকে বই থেকে ‘A woman waits for me, To a common prostitute, The dalliance of the Eagles’ এর অন্যান্য কবিতার আরও কয়েকটি লাইন মুছে ফেলতে বলেন। কবি সেটা করতে রাজি হন নাই; বলেছিলেন, সবচেয়ে আপত্তিজনক বই হচ্ছে বাধার মুখে লেখা মুছে ছাপানো বই তাঁর সারা জীবনেই আলোচক এবং সেন্সর অসমকামে কামগন্ধী কিছু লাইনের উপরে আলোকপাতের চেষ্টা করে গেছে, বিশেষ করে ‘I turn the bridegroom out of the bed and stay with the bride myself’। এমিলি ডিকিনসন এক বন্ধুকে লেখা চিঠিতে জানিয়েছিলেন যে, তিনি কোনোদিনই হুইটম্যানের লেখা পড়েন নাই, কিন্তু শুনেছেন যে সেগুলো খুবই আপত্তিজনক। হুইটম্যানের নানা চিঠি ও কবিতার লাইন তাঁর সমকামের প্রতি আকর্ষণ প্রকাশ করে। যে অংশটা আলোচকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে, এবং পাঠকেরাও কবির লাইনের মাধ্যমে বুঝতে পারে যে তারা তাকে অনুভবই করছেন।

হুইটম্যানের যৌনজীবন নিয়ে মানুষের এখনো ব্যাপক আগ্রহ। মাইকেল এঞ্জেলো বা মার্ক টোয়েন কাকে ভালোবাসতেন? তা নিয়ে খুব কম জানেন বা কারো আগ্রহ আছে জানার। কিন্তু হুইটম্যানে ক্ষেত্রে ব্যাপারটিই আলাদা। ক্যামডেনের ওয়াটার ফ্রন্টের এক পানশালায় উঁকি দিতে গেছিলাম, যে ধরনের জায়গাগুলোতে কবি নিজেও যেতেন, ভিতরে বেশ ভিড়ই ছিল। চলে আসার সময় বারটেন্ডার গ্লাস মোছা থামিয়ে বলে উঠল, তুমি নিশ্চয়ই হুইটম্যানকে সমকামী বলবে না, তাই তো? আমি তাঁর কবিতা পছন্দ করি এবং চাই না কেউ তাকে সেটা বলুক।

সেই আমলের সেন্সরশিপ নিয়ে তর্কবিতর্ক হুইটম্যানকে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসে, এবং সাহিত্যিকরাও তাঁর বই নিয়ে মূল্যায়ন অব্যাহত রাখেন। ট্রেজার আইল্যান্ড প্রকাশিত হবার কিছুদিন পরেই লেখা রবার্ট লুই স্টিভেনশন জানান লিভস অফ গ্রাস পড়ে তাঁর জানা জগত সম্পূর্ণ পালটে গেছে। স্টারি নাইট আকার সময় ভিনসেন্ট ভ্যানগগ লিভস অফ গ্রাস-এর একটা ফরাসি সংস্করণ পড়েন। ভিনসেন্ট তাঁর বোনকে লেখেন, ‘জগত জোড়া সুস্থ, জৈবিক প্রেম, সবল ও সাবলীল বন্ধুত্ব, কর্ম সবই যেন স্বর্গের এক নক্ষত্রময় ভল্টে হাজির, এটা তোমাকে সুখী করবে, এগুলো এতই খাঁটি এআর সাবলীল।

কিন্তু কবি মূলত যাদের জন্য লিখতেন, সেই সাধারণ মানুষ তাঁর কবিতা পড়ত না। লিংকনের মৃত্যুর পর লেখা ‘ও ক্যাপ্টেন, মাই ক্যাপ্টেন’ ছিল কবির জীবদ্দশায় জনপ্রিয়তা পাওয়া গুটিকয় কবিতার একটি।

O captain, my captain! Our fearful trip is done,
The ship has weather’d every rack, the prize we sought is won এবং এটি লিভস অফ গ্রাসের মাত্র দুটি ছন্দকবিতার একটি। এর সাফল্যের চেয়ে প্রচলিত ধারণার উপরে লেখা বলেই কবি বেশি চিন্তিত ছিলেন, তিনি বলেছিলেন ‘এই কবিতা তিনি সম্ভবত লিখতে চান নি’।

কবির চোখ দুটো সবসময়ই খুব সম্মোহক। কোনো ক্রোধ বা ভয় সেখানে দেখা যায় না। তিনি একজন আশাবাদী ছিলেন। লিভস অফ গ্রাস- এর পরিপূর্ণ সংস্করণের শেষ লাইন ছিল ‘the strongest and sweetest songs yet remain to be sung’ দেহ যখন ক্রমেই অসুস্থ হয়ে যাচ্ছিল ‘the strange inertia falling pall-like over me’, তিনি তাঁর গর্জন হারিয়ে ফেললেও বোধ হারান নি, ‘Have you not learn’d lessons only of those who admired you and were tender you?’ তাঁর প্রশ্ন ছিল ‘have you not learned lessons from those who reject you, and brace themselves against you?’

মানবতার জয়গান গাইলেও হুইটম্যান তাঁর কালকে অস্বীকার করতে পারেন নি। সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত কৃষ্ণাঙ্গ দাসদের তিনি পূর্ণ নাগরিক হিসাবে গ্রহণের জন্য প্রচারণা চালান নি। সারা জীবন এই বিশ্বাস নিয়েই চলেছেন যে আমাদের মগজের আকৃতিই আমাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ঠিক করে দেয়। ১৮৯২ সালে ৭২ বছর বয়সে মৃত্যুর পড়ে তাঁর মগজ ফিলাডেলফিয়ার ‘Anthropometic’ সোসাইটিতে পাঠানো হয়, এই আশায় যে পরীক্ষার পর জানা যাবে কেন তিনি এতো অসাধারণ ছিলেন।

তৎক্ষণাৎ পরীক্ষায় দেখা যায় যে, তাঁর মগজ একটু ক্ষুদ্রাকৃতির ছিল। তারপর এক ল্যাবরেটরি কর্মীর হাত থেকে দুর্ঘটনাবশত এটি পড়ে যায়, কবির মগজটি এরপর ফেলে দেওয়া হয়।

১৮৮০র দিকে কবি বুঝতে পারেন তাঁর জীবদ্দশায় লিভস অফ গ্রাস গণমানুষের কাছে বিপুলভাবে জায়গা করে নিতে পারবে না। তিনি ভবিষ্যতের উপরেই আস্থা রাখেন। কবি মনে করতেন, আসল বোঝার স্বাদ আসতে শতবর্ষ লাগে।

শত বছর পেরিয়ে গেছে। হুইটম্যানের প্রভাব অনন্য। তাঁর ব্যক্তিত্ব, আত্মবিশ্বাস, অবহেলিতের প্রতি বন্ধুত্ব, সমতার জয়গান, নিসর্গ প্রেম- সবই আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। দ্য ইভুলুশন অফ ওয়াল্ট হুইটম্যান গ্রন্থের লেখক, সরবোর্ন প্রফেসর রজার অ্যাসেলিনিউ মনে করেন, ‘অধিকাংশ মার্কিনীর চিন্তারও বাহিরে যে হুইটম্যান কতটা গুরুত্বপূর্ণ।’ প্যারিসের লেফট ব্যাংকের এক ক্যাফেতে আলাপের সময় সে বলে ওঠে ‘হুইটম্যানের ভিতরে ছাত্ররা সেই বিশেষ উপমাটির সন্ধান পায়, যার ফলে তারা সেটা পড়তে পারে যেটা তাদের প্রয়োজন। নারীর সমঅধিকার। যৌনতার স্বাধীনতা। অনুভূতি প্রকাশের স্বাধীনতা।’

যদিও কবি হুইটম্যান চাইতেন আমজনতার পকেটে পকেটে তাঁর বই থাকবে, আমাদের খবরের কাগজের দোকানে এ থাকবে, সেই দিকে দিয়ে কবি এখনো ব্যর্থ।

এই ব্যর্থতা আমাদের। বাহিরে যাও, জোরে জোরে কবিতা পড়। অ্যাডভেঞ্চার অপেক্ষমান। আপনি হয়তো নিজের সেই অংশের সন্ধান পাবেন, যেটা অস্তিত্বের অনুপস্থিতি আপনি জানতেনও না।

spot_img
spot_img

এই বিভাগের আরও পড়ুন

চট্টগ্রাম

সারাদেশ

বিশেষ-সংবাদ

বিনোদন