একদিকে ফাঁস হচ্ছে একের পর এক জালিয়াতি এবং অনিয়মের খবর। অন্যদিকে বোর্ডের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের গ্রুপিং। সবমিলিয়ে বেসামাল চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ড। বৃহত্তর চট্টগ্রামের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানটি হঠাৎ ইমেজ সংকটে পড়েছে।
এরই মধ্যে শিক্ষা বোর্ডের নানা অভিযোগ নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে তদন্তে নেমেছে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক অধিদপ্তর (মাউশি)। পাশাপাশি চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের নানা অভিযোগ গড়িয়েছে আদালতে এবং থানায়। এসব অভিযোগ তদন্ত করে দেখছে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজমসহ একাধিক সংস্থা। একই সঙ্গে শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানের নির্দেশে অভ্যন্তরীণ তদন্তও শিগগির শুরু হচ্ছে বলে জানা গেছে।
তবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়ন্ত্রক এই বোর্ডের বেহাল দশা দেখে ক্ষুব্ধ সুশীল সমাজ। জালিয়াতি, অনিয়ম এবং গ্রুপিং বন্ধে তারা সংশ্লিষ্টদের ব্যবস্থা গ্রহণে দাবি জানিয়েছেন।
শীর্ষ দুই কর্মকর্তার মধ্যে দ্বন্দ্ব
চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের সাবেক পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ও বর্তমানে সচিবের দায়িত্বে থাকা নারায়ণ চন্দ্র নাথ ও সাবেক সচিব অধ্যাপক আবদুল আলীমের মধ্যে নানা বিষয়ে মতবিরোধ চলে আসছিল। গত বছরের শেষের দিকে সেটি প্রকাশ্যে আসে। চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজ থেকে ২০২৩ সালের এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন নারায়ণ চন্দ্র নাথের ছেলে নক্ষত্র দেবনাথ। ওই বছরের ২৬ নভেম্বর প্রকাশিত ফলাফলে বাংলা বিষয় ছাড়া সব বিষয়ে জিপিএ ৫ পান নক্ষত্র। তবে বাংলায় এ পেলেও অতিরিক্ত বিষয়ের পয়েন্ট যুক্ত হওয়ায় সামগ্রিক ফলাফলে তিনি জিপিএ ৫ পান।
ওই বাংলা বিষয়ে পুনঃনিরীক্ষণের আবেদন করতে গিয়ে নক্ষত্রের পরিবারের লোকজন দেখেন আগে থেকে অনলাইনে পুনঃনিরীক্ষণের জন্য কে বা কারা আবেদন করে দিয়েছেন। তাও শুধুমাত্র একটি বিষয়ে না, ১২টি উত্তরপত্র পুনঃনিরীক্ষণের আবেদন করা হয়। বিষয়টি নিয়ে বোর্ড সচিব নারায়ণ চন্দ্র নাথের স্ত্রী বনশ্রী নাথ গত বছরের ৪ ডিসেম্বর নগরের পাঁচলাইশ থানায় জিডি করেন। এটির তদন্তে নেমে পুলিশ জানতে পারে শিক্ষা বোর্ডের সাবেক সচিব অধ্যাপক আবদুল আলীমের মোবাইল ফোন নম্বর রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করে নক্ষত্র দেবনাথের নামে পুনর্নিরীক্ষণের আবেদনটি করা হয়েছিল। বিষয়টি উল্লেখ করে গত ১৫ জানুয়ারি আদালতে প্রতিবেদন জমা দেয় পাঁচলাইশ থানা পুলিশ।
আদালতের প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর নারায়ণ চন্দ্র নাথের স্ত্রী বনশ্রী নাথ চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের সাবেক সচিব আবদুল আলীম ও চট্টগ্রাম কলেজের সাবেক অধ্যাপক মুহাম্মদ ইদ্রিস আলীর বিরুদ্ধে সাইবার নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন। মামলাটি তদন্ত করছে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট। এরই মধ্যে সচিবের ছেলের ফলাফল নিয়ে নানা ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে তদন্তে নেমেছে মাউশি। তদন্ত কমিটির দুই সদস্য গত ৩ জুন চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডে যান। তারা হলেন- কমিটির আহ্বায়ক মাউশির মনিটরিং ও ইভ্যালুয়েশন উইংয়ের পরিচালক অধ্যাপক মো. আমির হোসেন এবং সদস্য মাউশির ইএমআইএস সেলের সিনিয়র সিস্টেম অ্যানালিস্ট খন্দকার আজিজুর রহমান।
এদিকে মাউশির কর্মকর্তাদের সাক্ষাৎকার গ্রহণের সময় ঘটে আরেক কাণ্ড। ওইদিন কমিটির সদস্য না হয়ে সাক্ষাৎকারের সময় উপস্থিত ছিলেন বোর্ডের উপসচিব বেলাল হোসেন।
বিষয়টি নিয়ে সরাসরি চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানের দিকে আঙুল তুলেছেন সচিব নারায়ণ চন্দ্র নাথ। আজ (বৃহস্পতিবার) বিষয়টি নিয়ে তিনি বলেন, ওইদিন তদন্ত কমিটির সদস্য না হয়ে একজন সাক্ষাৎকার গ্রহণের সময় উপস্থিত ছিলেন। এটি আপনারা দেখেছেন। তার কারণে কেউ যথাযথ বক্তব্য দিতে পারেননি। আমি মনে করি প্রতিষ্ঠান প্রধানের অনুমতি ছাড়া কেউ তো আর এভাবে উপস্থিত থাকতে পারেন না।
এ প্রসঙ্গে শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান রেজাউল করিম বলেন, তদন্ত কমিটিকে সার্বিক সহযোগিতা করার জন্য বোর্ডের চার কর্মকর্তাকে আমি দায়িত্ব দিয়েছিলাম। সেই চারজনের একজন উপসচিব বেলাল হোসেন। তিনি তদন্ত কমিটিকে সহযোগিতা করতে সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় উপস্থিত ছিলেন।
মূলত এ ঘটনার পর থেকে শিক্ষা বোর্ডের সচিব নারায়ণ এবং বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেজাউল করিমের মধ্যে দ্বন্দ্ব আরও প্রকট হয়।
শিক্ষা বোর্ডের অফিস কক্ষের ট্রাংক থেকে শিক্ষার্থীর মার্কশিট উধাও
চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের উপপরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মো. দিদারুল আলম। বোর্ডের চার তলায় তার কক্ষের তিনটি ট্রাংকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা-২০২৩ এর শিক্ষার্থীদের লক্ষাধিক নম্বরফর্দ রক্ষিত ছিল। গত ১৯ মে সকাল ১০টার দিকে দেখা যায়, ওই তিন ট্রাংকের মধ্যে একটি ট্রাংকের লাগানো তালা নেই। ঘটনা জানাজানির পর মাউশির তদন্ত কর্মকর্তাদের নির্দেশে ৩ জুন বিকেলে শিক্ষা বোর্ডের দুজন কর্মকর্তার উপস্থিতিতে ভাঙা ট্রাংকটিতে খোঁজ নিয়ে দেখা যায় সেখানে শিক্ষার্থীদের দুটি নম্বরফর্দ নেই।
পুলিশ ও শিক্ষা বোর্ড কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ ঘটনায় তড়িঘড়ি করে উপসচিব দিদারুল আলমকে পাঁচলাইশ থানায় জিডি করতে নির্দেশ দেন বোর্ডের চেয়ারম্যান। তবে দিদারুল আলম বিষয়টি তার দায়িত্ব নয় উল্লেখ করে প্রথমে জিডি করতে অপারগতা প্রকাশ করে। তার যুক্তি মার্কশিট উধাও হলে সেটির আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের। তবে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক নিজে বোর্ডের সচিব নারায়ণ চন্দ্রের লোক বলে পরিচিত হওয়ায় তাকে বাদ দিয়ে চেয়ারম্যান উপপরীক্ষা নিয়ন্ত্রককেই জিডি করতে নির্দেশ দেন। একপর্যায়ে চেয়ারম্যানের চাপে পাঁচলাইশ থানায় জিডি করতে যান দিদারুল আলম।
সেখানে বাধে আরেক বিপত্তি। চেয়ারম্যানের লিখিত নির্দেশ ছাড়া জিডি নিতে আপত্তি জানায় পাঁচলাইশ থানা পুলিশ। একপর্যায়ে হাতে লিখিত একটি কাগজে জিডির অনুমতি দেয় শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান। এরপর ৪ জুন জিডিটি রেকর্ড হয়।
এ বিষয়ে পাঁচলাইশ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সন্তোষ কুমার চাকমা বলেন, শিক্ষা বোর্ডের উপসচিবের দায়ের করা জিডিটি তদন্তের জন্য তিনজনের সমন্বয়ে একটি কমিটি করে দেব। তারা বিষয়টি দেখবেন।
শুধু আইসিটি পরীক্ষা না দিয়ে পাস ১৭ জন
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিষয়ে পরীক্ষা না দিয়ে পাস করেছে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের ১৭ জন শিক্ষার্থী। দুজন শিক্ষার্থীর বিষয়ে তদন্তে নেমে আরও ১৫ জনকে শনাক্ত করে শিক্ষা বোর্ড। মূলত কুমিল্লা থেকে আনা দুজন বিশেষজ্ঞ ঘটনাটি শনাক্ত করে।
বিষয়টি জানাজানির পর বোর্ডের কর্মকর্তাদের মধ্যে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। এটি কোনো কর্মকর্তা বা কর্মকর্তাদের যোগসাজশে জালিয়াতি নাকি ভুলক্রমে হয়েছে, সেটি নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। আবার কোনো কোনো কর্মকর্তা জানিয়েছেন, যে প্রক্রিয়ায় ফলাফল প্রস্তুত হয় সেটিতে কোনো কর্মকর্তার যোগসাজশ না থাকলে এতো বড় জালিয়াতির ঘটনা ঘটতো না। এ ছাড়া, আইসিটি বাদে অন্য কোনো বিষয়ে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে কি না, সে বিষয়ে তদন্তে নামছে শিক্ষা বোর্ড।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চট্টগ্রামের বাঁশখালীর চাম্বল উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এসএসসি পরীক্ষার কেন্দ্র ছিল বাঁশখালী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়। মাধ্যমিকে আইসিটি বিষয়ে নৈর্ব্যক্তিক ও ব্যবহারিকে ২৫ নম্বর করে ৫০ নম্বরের পরীক্ষা হয়। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ওই বিষয়ের নৈর্ব্যক্তিক পরীক্ষা ছিল। ৩০ মিনিটের নৈর্ব্যক্তিক পরীক্ষার কেন্দ্রেই উপস্থিত হয়নি দুই শিক্ষার্থী। অথচ গত ১২ জুন প্রকাশিত এসএসসির ফলাফলে দেখানো হয়, তারা দুজন আইসিটি বিষয়ের পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে।
প্রকাশিত ফলাফলে দেখা যায়, ব্যবহারিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ দেখিয়ে পরীক্ষাকেন্দ্র (বাঁশখালী-০১) থেকে দুই পরীক্ষার্থীর নম্বরপত্র পাঠানো হয়। একইভাবে অনুপস্থিত দুই শিক্ষার্থীর উত্তরপত্র জমা না হওয়া সত্ত্বেও তত্ত্বীয় (নৈর্ব্যক্তিক) পরীক্ষায়ও সর্বোচ্চ নম্বর দিয়ে তাদের জিপিএ-৫ পাইয়ে দেন বোর্ড পরীক্ষকরা।
বিষয়টি জানাজানির পর ঘটনার বিষয়ে খোঁজ নিতে কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ড থেকে দুজন বিশেষজ্ঞ আনা হয় চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডে। তারা আগের দুজনসহ মোট ১৭ জন আইসিটি পরীক্ষায় অংশ না নিয়েও পাস করার বিষয়টি শনাক্ত করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ১০ জুন শিক্ষা বোর্ডের এক সভায় ১৭ শিক্ষার্থীর ফল বাতিল ঘোষণা করা হয়।
আইসিটি বাদে অন্য বিষয়ে এমন ঘটনা ঘটেছে কি না— জানতে চাইলে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেজাউল করিম বলেন, আমরা আইসিটি বিষয়ে মোট ১৭ জনকে শনাক্ত করেছি। এ ঘটনায় শিগগির একটি তদন্ত কমিটি করে দেব। তারা প্রতিবেদন দাখিল করলে এ বিষয়ে আইনানুগ যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। ইচ্ছাকৃত এবং অনৈতিক সুবিধার জন্য কেউ জড়িত থাকলে তাদের বিষয়ে ফৌজদারি মামলাও দায়ের করা হবে।
জালিয়াতি ও অনিয়মসহ বোর্ডের সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে অধ্যাপক রেজাউল করিম বলেন, আমি দায়িত্ব নিয়েছি বেশিদিন হয়নি। খোঁজ নিলে জানতে পারবেন ঘটনাগুলো আরও আগের। তবে সাম্প্রতিক এসব কর্মকাণ্ডে শিক্ষা বোর্ডের ইমেজ সংকট হচ্ছে। আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি বোর্ডের সম্মান ফিরিয়ে আনার।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. ইফতেখার উদ্দিন বলেন, চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ড চট্টগ্রামের মানুষের বিভিন্ন আন্দোলনের ফসল। বোর্ডের এমন কর্মকাণ্ড দেখে আমরা দুঃখ পাই। আগেও কতিপয় অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে চট্টগ্রাম মহানগরের কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে অনৈতিক সুবিধা দেওয়ার গুঞ্জন ছিল। এখন ফলাফল জালিয়াতির মতো ঘটনা ঘটছে। এসএসসির একজন শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবনের প্রথম সনদ এটি। এতে জালিয়াতি হলে পুরো শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রভাব পড়বে।
পরিত্রাণের উপায় জানতে চাইলে তিনি বলেন, শুধুমাত্র লোক-দেখানো তদন্ত কমিটি নয়। একজন বিচারকের নেতৃত্বে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের নিয়ে শক্তিশালী কমিটি গঠন করতে হবে। তাদের মাধ্যমে অনিয়ম ও জালিয়াতিতে জড়িত প্রকৃত অপরাধীদের শনাক্ত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। তবে এর লাগাম টানা সম্ভব হবে।