দেশে লবণ উৎপাদনের মৌসুম শুরু হয় নভেম্বরে। গত বছর তিনটি ঘূর্ণিঝড় এবং চলতি শৈত্যপ্রবাহ ও শীতের বৃষ্টিপাত ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে এ উৎপাদন মৌসুমে। উৎপাদন কমায় বাজারে লবণের দাম বেড়েছে। এ কারণে মাঠ থেকে আহরণ হচ্ছে অপুষ্ট লবণ, যা পরিশোধন বা ক্রাশিংয়ের পর উৎপাদন ঘাটতি বাড়াচ্ছে।
লবণ খাতসংশ্লিষ্ট সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সূত্রে জানা গেছে, স্বাভাবিক সময়ে মাঠ তৈরির পর সর্বোচ্চ ১৪ দিনে পরিপূর্ণ আকৃতির দানাদার লবণ উৎপাদন হয়। গ্রীষ্মকালীন মৌসুমে সর্বনিম্ন তিন থেকে নয়দিনে লবণ উত্তোলন করা যায়। কিন্তু চলতি উৎপাদন মৌসুমে বিরূপ আবহাওয়ার কারণে মাসভিত্তিক লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে উৎপাদন হচ্ছে কম।
মিল মালিকরা জানিয়েছেন, স্বাভাবিক সময়ে সাধারণ মিলগুলোয় লবণ পরিশোধনে ঘাটতি হত ৫-১০ শতাংশ। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে মাঠ থেকে আসা লবণে ঘাটতি থাকছে ২০-৩০ শতাংশ। অন্যদিকে স্বাভাবিক লবণের ক্ষেত্রে ভ্যাকুয়াম প্রযুক্তির মিলগুলোয় পরিশোধনে ঘাটতি হতো ৩০-৩৫ শতাংশ, বর্তমানে দেশীয় মাঠ থেকে উৎপাদিত লবণ পরিশোধনে ঘাটতি হচ্ছে ৪০-৫০ শতাংশ।
ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, কয়েক সপ্তাহ আগে লবণের মণপ্রতি দাম ছিল ৬০০-৬৫০ টাকা। বর্তমানে তা কমে নেমে এসেছে ৫০০-৫২০ টাকায়। কমার পরও চাষীরা বর্তমান দামে লাভবান। এ কারণে মাঠ থেকে অপুষ্ট লবণ উত্তোলন থামছে না।
বিসিক সূত্রে জানা গেছে, গত বছর ৬৩ বছরের ইতিহাসে ৬৬ হাজার ৪২০ একর জমিতে রেকর্ড ২২ লাখ ৩০ হাজার টন লবণ উৎপাদন হয়েছিল। উৎপাদন বেশি হওয়ার পাশাপাশি ভালো দাম পাওয়ায় এ বছর লবণ উৎপাদন অন্তত তিন হাজার একর বৃদ্ধির সম্ভাবনা দেখছে বিসিক। গত বছরে ৩৯ হাজার ৪৬৭ চাষী লবণ মাঠে কাজ করলেও এ বছর চাষীর সংখ্যা আনুপাতিক হারে বাড়বে। জমি, চাষী ও চাহিদা বৃদ্ধিজনিত কারণে এ বছর লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২৫ লাখ ২৮ হাজার টন। নভেম্বরের মাঝামাঝিতে উৎপাদন মৌসুম শুরু হওয়ার কথা থাকলেও দামের কারণে আরো আগে মাঠে নেমে যান চাষীরা। এর পরও সর্বশেষ ২৭ জানুয়ারি পর্যন্ত দেশে লবণ উৎপাদন হয়েছে ১ লাখ ৬৩ হাজার ৪৭২ টন। ২০২৩ সালের ২৭ জানুয়ারি পর্যন্ত দেশে লবণ উৎপাদন হয়েছিল ২ লাখ ৭৭ হাজার টন। আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ১ লাখ ১৪ হাজার টন কম উৎপাদন হয়েছে, যা বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিসিকসহ খাত সংশ্লিষ্টরা।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, একসময় খুলনা অঞ্চলেও মাঠ পর্যায়ে লবণ উৎপাদন হতো। সেটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দেশে লবণ উৎপাদনের কেন্দ্র হয়ে উঠেছে কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম জেলার কয়েকটি উপজেলা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি লবণ উৎপাদন হয় কক্সাবাজারে। চলতি বছর কক্সবাজারের ঈদগা উপজেলায় ৪ হাজার ৭০০ একর, সদরে ৩ হাজার ৭০০, কুতুবদিয়ায় ৬ হাজার ৭৬৭, টেকনাফে ৪ হাজার ৪২১, চকরিয়ায় ১১ হাজার, পেকুয়ায় ১০ হাজার ৪০, মহেশখালীতে ১৬ হাজার ৬০০, চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলায় চার হাজার ও পটিয়ায় ৫৫ একর জমিতে লবণ চাষ হচ্ছে।
কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলার রাজাখালী ইউনিয়নের চাষী মো. ইয়াছিন এ বছর ১২ কানি (৪৮০ শতাংশ) জমিতে লবণ চাষ করেছেন। কয়েক বছর আগে ছয় মাসের জন্য শ্রমিক নিয়োগে ৫০-৬০ হাজার টাকা (দুই বেলা খাবারসহ) খরচ হতো। বর্তমানে মজুরি বেড়ে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা হয়ে গেছে। সব মিলিয়ে বেড়েছে উৎপাদন খরচ। লবণ উৎপাদনে সময় লাগছে ১০ দিনেরও বেশি। আমদানির ফলে বাজারে দাম কমে গেছে। এ কারণে সাত-আট দিনের মধ্যেই লবণ উত্তোলন করছেন। তার আশঙ্কা, এরপর দাম আরো কমে গেলে লোকসান হবে।
বিসিক সূত্রে জানা গেছে, মৌসুমের শুরুতে উৎপাদন কম হওয়ায় ২০২৩ সালের ১৪ নভেম্বর তিন ক্যাটাগরিতে ২৬৪টি মিল মালিক প্রতিষ্ঠানকে এক লাখ টন লবণ আমদানির অনুমতি দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে প্রথম শ্রেণীর (এ ক্যাটাগরি) ছয়টি মিলের প্রতিটিকে ১ হাজার ৩৯৪ টন করে মোট ৮ হাজার ৩৬৪ টন, দ্বিতীয় শ্রেণীর (বি ক্যাটাগরি) ৪৯টি মিলের প্রতিটিকে ৫৫০ টন করে মোট ২৬ হাজার ৯৫০ ও তৃতীয় শ্রেণীর (সি ক্যাটাগরি) ২০০টি মিলের প্রতিটিকে ৩০৬ টন করে মোট ৬১ হাজার ২০০ টন রয়েছে। যদিও নভেম্বরের শেষার্ধে ভারতে ঘূর্ণিঝড়ের কারণে আমদানির লবণ জাহাজীকরণে জটিলতায় দেশে পৌঁছতে বিলম্ব হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ লবণ মিল মালিক সমিতির সভাপতি নুরুল কবির বলেন, ‘দেশে মাসভিত্তিক লবণের চাহিদা দুই লাখ টনের কাছাকাছি। বিরূপ আবহাওয়ার কারণে মৌসুমের শুরুতে উৎপাদন উল্লেখযোগ্য পরিমাণ হয়নি। যার কারণে বাড়তি দাম ও খরচ পোষাতে মাঠ থেকে অপুষ্ট লবণ উত্তোলন করছেন চাষীরা। এসব লবণ ক্রাশিং করতে ঘাটতির পরিমাণ বেড়ে গেছে। সরকারিভাবে আমদানির অনুমতি দেয়া হলেও বাড়তি লবণ সরবরাহ না হলে আসন্ন রমজানে বাজার অস্থিতিশীল হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।’
আমদানি হওয়া লবণ দেশে পৌঁছার পর পরই নতুন করে আরো অন্তত এক মাসের অপরিশোধিত লবণের ব্যবস্থা করতে শিল্প মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ লবণ মিল মালিক সমিতি। ১৭ জানুয়ারি মন্ত্রণালয়ের সচিবকে দেয়া চিঠিতে জানানো হয়েছে, ঘূর্ণিঝড়সহ বৈরী আবহাওয়ার কারণে এ বছর লবণ উৎপাদনের ভরা মৌসুম পিছিয়ে গেছে। মাঠে দানাদার ও পুষ্ট লবণ আসতে মার্চ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। যার কারণে আসন্ন রমজানের আগে মিল পর্যায়ে পরিশোধনের জন্য অন্তত এক মাসের লবণ সরবরাহের ব্যবস্থা করতে অনুরোধ জানানো হয়েছে।
যোগাযোগ করা হলে দেশের অন্যতম ভ্যাকুয়াম লবণ উৎপাদনকারী কোম্পানি কনফিডেন্স সল্টের বিপণন প্রধান সরদার নওশাদ ইমতিয়াজ বলেন, ‘প্রাকৃতিক দূর্যোগের কারণে এবছর লবণের উৎপাদন ও গুণগত মান দুটোই কমেছে। আমদানি হওয়া লবণের মজুদ ফুরিয়ে আসায় কয়েক দিনের মধ্যেই দেশীয় লবণের ওপর নির্ভর করতে হবে আমাদের। এতে লবণ প্রক্রিয়াজাত করে লাভ করা কঠিন হয়ে যাবে বলে।’
লবণ উৎপাদন ও প্রক্রিয়াকরণসংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে রোদের পরিমাণ কম থাকায় ১০ দিনে উত্তোলিত লবণের বাইরের অংশ শক্ত আকার ধারণ করলেও ভেতরে জলীয় অংশ থেকে যায়। এসব লবণ মাঠ থেকে বাজার পর্যন্ত নিয়ে যেতে পানি ঝরে পরিমাণ কমে যায়। আবার ক্রাশিংয়ের সময় ভেতরের জলীয় অংশের একটি বড় অংশ দানা থেকে বের হয়ে যাওয়ায় উৎপাদনে ঘাটতি তৈরি হচ্ছে। ফলে সাম্প্রতিক সময়ে দেশীয় লবণ বাজার থেকে সংগ্রহ করলেও প্রস্তুত লবণের পরিমাণ কমছে।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে বিসিকের লবণ শিল্প উন্নয়ন কার্যালয় কক্সবাজারের উপমহাব্যবস্থাপক মো. জাফর ইকবাল ভূঁইয়া বলেন, ‘প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে এ বছর লবণ উৎপাদন শুরুতে কম হয়েছে। সংকট এড়াতে আমদানির অনুমতি দেয়ায় দেশে উৎপাদিত লবণের দামও কমছে। বাড়তি দামের আশায় চাষী পর্যায়ে অপুষ্ট লবণ আহরণ হচ্ছে, এটা মিথ্যা নয়। কুয়াশা ও অকালবৃষ্টিতে মাঠ থেকে লবণ উত্তোলনে বেশি সময় ব্যয় হওয়ায় কৃষক বিনিয়োগ ফিরে পেতে দ্রুত উত্তোলনে যাচ্ছেন। এ সমস্যা দ্রুত কেটে যাবে। তাপমাত্রা বাড়লে স্বাভাবিক লবণ উৎপাদনের ধারা ফিরে আসবে। শুরুতে কম উৎপাদন হলেও কয়েক মাস সময় পেলে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন এবং ভালো মানের লবণ উৎপাদন সম্ভব।’