Google search engine
প্রচ্ছদজাতীয়সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি পাসপোর্ট সেবায়: টিআইবি

সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি পাসপোর্ট সেবায়: টিআইবি

বাংলাদেশের ৭০ দশমিক ৯ শতাংশ খানা বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি খাত বা প্রতিষ্ঠানের সেবা নিতে গিয়ে কোনো না কোনো ধরনের দুর্নীতির শিকার হয়েছে। এর মধ্যে পাসপোর্ট সেবা নিতে গিয়ে সবচেয়ে বেশি ৮৬ শতাংশ খানা দুর্নীতির শিকার হয়েছে। এর পরেই রয়েছে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি-বিআরটিএ, যেখানে সেবা নিতে গিয়ে দুর্নীতির শিকার হয়েছে ৮৫ দশমিক ২ শতাংশ খানা।

এমন তথ্য উঠে এসেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক জরিপে। মঙ্গলবার (৩ ডিসেম্বর) ঢাকার ধানমন্ডির মাইডাস সেন্টারে সংবাদ সম্মেলন করে ‘সেবাখাতে দুর্নীতি: জাতীয় খানা জরিপ ২০২৩’ ফল প্রকাশ করা হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সংজ্ঞানুযায়ী, যে কয়জন ব্যক্তি একই রান্নায় খাওয়াদাওয়া এবং একসঙ্গে বসবাস করে, তাদের একত্রে একটি খানা বা হাউসহোল্ড বলা হয়।

টিআইবি জানায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার সেবা নিতে গিয়ে ৭৪ দশমিক ৫ শতাংশ, বিচারিক সেবা পেতে ৬২ দশমিক ৩ শতাংশ, ভূমি সেবা পেতে ৫১ শতাংশ খানা দুর্নীতির শিকার হয়েছে। এছাড়া সরকারি স্বাস্থ্য সেবা পেতে ৪৯ দশমিক ১ শতাংশ এবং স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে সেবা নিতে গিয়ে ৪৪ দশমিক ২ শতাংশ খানা দুর্নীতির শিকার হয়েছে।

টিআইবি আরও জানায়, সার্বিকভাবে ৫০ দশমিক ৮ শতাংশ খানা সেবা নিতে গিয়ে ঘুষ বা নিয়মবহির্ভূত অর্থ দিয়েছে বা দিতে বাধ্য হয়েছে। এ জরিপে অন্তর্ভুক্ত খাতে ২০২৩ সালের মে থেকে শুরু করে ২০২৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত সেবা নিতে গিয়ে যেসব খানাকে ঘুষ বা নিয়মবহির্ভূত অর্থ দিতে হয়েছে, তার পরিমাণ গড়ে ৫ হাজার ৬৮০ টাকা।

সর্বোচ্চ ঘুষ বা নিয়মবহির্ভূত অর্থ আদায়কারী খাতগুলোর মধ্যে বিচারিক সেবা (খানাপ্রতি গড়ে ৩০ হাজার ৯৭২ টাকা), ভূমি সেবা (খানাপ্রতি গড়ে ১১ হাজার ৭৭৬ টাকা), ব্যাংকিং সেবা (খানাপ্রতি গড়ে ৬ হাজার ৬৮১ টাকা) এবং বিআরটিএ সেবা (খানা প্রতি গড়ে ৬ হাজার ৬৫৪ টাকা) অন্যতম।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এই জরিপের মাধ্যমে দেশের জনসাধারণ বিভিন্ন সেবাখাত হতে সেবা নিতে গিয়ে যে দুর্নীতির শিকার হয় তার ধরন, ব্যাপকতা ও মাত্রা নির্ধারণ করা হয়। এই জরিপের প্রধান উদ্দেশ্য সরকার, নীতি-নির্ধারক, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও অন্যান্য অংশীজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করা, যেন তারা জরিপের ফলাফল ও তার ওপর ভিত্তি করে টিআইবি প্রণীত সুপারিশ বিবেচনায় নিয়ে দুর্নীতি প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে।

টিআইবি পরিচালিত এই জরিপ খানার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার তথ্যের ওপর নির্ভর করে জানিয়ে তিনি বলেন, জরিপে প্রাপ্ত তথ্য থেকে প্রতীয়মান হয়, বিচারিক সেবা ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থায় দুর্নীতি ও ঘুষের উচ্চ হার অব্যাহত, যা সাধারণ জনগণের ন্যায়বিচার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বড় বাধা। অন্যদিকে ভূমি সেবা, পাসপোর্ট, জাতীয় পরিচয়পত্র এবং বিআরটিএর মতো সেবায় উচ্চ দুর্নীতি ও ঘুষ বিদ্যমান, যা মানুষের দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োজনীয় সেবা প্রাপ্তির অধিকারকে বাধাগ্রস্ত করছে।

টিআইবির জরিপ জানায়, যেসব খানার মাসিক আয় ২৪ হাজার টাকার কম, তাদের বার্ষিক আয়ের শূন্য দশমিক ৯৩ শতাংশ শুধু ঘুষ হিসেবে খরচ করতে হয়। আর মাসিক আয় ৮৫ হাজার টাকার বেশি এমন খানার ক্ষেত্রে এ হার শূন্য দশমিক ২১ শতাংশ।

প্রক্রিয়াগত জটিলতা ও হয়রানির ভয়ে দুর্নীতির শিকার খানাগুলোর অভিযোগ জানাতে অনীহা রয়েছে জানিয়ে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, অভিযোগ জানানোর পদ্ধতি সম্পর্কে একদিকে বেশিরভাগ (৫৯.৬%) খানার কোনো ধারণা নেই, যাদের আছে (৪০.৪%) তারাও বিশেষ করে দুদক ও জিআরএস সম্পর্কে খুব কম ধারণা রাখে। অন্যদিকে, যারা অভিযোগ করেছে তাদের প্রায় ৫০ শতাংশ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান থেকে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি এবং প্রায় ২০ শতাংশ ক্ষেত্রে অভিযোগ গ্রহণ করা হয়নি, যা দুর্নীতির প্রতিকারে প্রবল অনীহা ও অব্যবস্থাপনাকে নির্দেশ করে।

জরিপে প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে নীতি-নির্ধারণী এবং প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে বাস্তবায়নের জন্য কিছু সুপারিশ করেছে টিআইবি, যার মধ্যে আছে-

১. সেবাখাতে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে দমন কমিশনের (দুদক) পাশাপাশি প্রযোজ্য ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও প্রতিষ্ঠানকে সক্রিয় ভূমিকা পালন করা।

২. সেবা পুরোপুরি ডিজিটাইজ করতে হবে- যেন সেবাগ্রহীতার সাথে সেবাদাতার প্রত্যক্ষ যোগাযোগের প্রয়োজন না হয় এবং অনলাইনে সেবাগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করতে যথাযথ প্রচারণা চালানো। সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানে ‘ওয়ান স্টপ’ সার্ভিস চালু করা এবং তার প্রয়োগ নিশ্চিত করা।

৩. সেবাদানকারী প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে সেবাদাতার জন্য যুগোপযোগী আচরণবিধি প্রণয়ন করা; যেখানে কোন সেবা কীভাবে ও কত সময়ের মধ্যে দিতে হবে, সেবাগ্রহীতার সাথে কী আচরণ করতে হবে ইত্যাদি উল্লেখ করা থাকবে। প্রত্যেক সেবা গ্রহণের পর সেবাদাতার মতামত নেওয়ার ব্যবস্থা করা।

৪. বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সেবাদানের সাথে জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মেধা ও কর্মদক্ষতার ভিত্তিতে পদোন্নতি, পদায়নের ব্যবস্থা করা। দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের পদোন্নতি, পদায়ন ও পুরস্কার দেওয়া বন্ধ করা।

৫. সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের নাগরিক সনদে সেবার মূল্য ও সেবা প্রাপ্তির সময় সম্পর্কিত তথ্য নিয়মিত হালনাগাদ করা এবং তা দৃশ্যমান স্থানে স্থাপন করা। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কার্যকর করা যেখানে সেবাগ্রহীতার সক্রিয় অংশগ্রহণ থাকবে।

৬. যেসব খাতে জনবল, অবকাঠামো ও লজিস্টিকসের কারণে সেবাদান ব্যাহত হয়, সেসব খাতে বিদ্যমান ঘাটতি দূর করা; কর্মীদের দক্ষতা বাড়াতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা।

৭. সেবাখাতে গ্রাহক হয়রানি বন্ধ এবং অভিযোগ নিরসন ব্যবস্থার অংশ হিসেবে-‘গ্রিভেন্স রিড্রেস সিস্টেম (জিআরএস)’ সম্পর্কে ব্যাপক প্রচারণা চালানো।

৮. সেবাদাতা সব প্রতিষ্ঠানে অভিযোগ বাক্স স্থাপন করা। পাশাপাশি এসএমএস, ইমেইল, ওয়েবসাইট ইত্যাদির মাধ্যমে অভিযোগ গ্রহণের ব্যবস্থা করা।

৯. অভিযোগ লিপিবদ্ধ করার রেজিস্টার সংরক্ষণ করা এবং অভিযোগগুলো নিয়মিত পর্যালোচনা করে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

১০. সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বৃদ্ধির লক্ষ্যে গণশুনানি ও সামাজিক নিরীক্ষার মতো জনগণের অংশগ্রহণমূলক কার্যক্রম নিয়মিত পরিচালনা করা।

১১. সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীর সম্পদ বিবরণী বার্ষিক ভিত্তিতে বাধ্যতামূলকভাবে হালনাগাদ করে জমা দেওয়ার ব্যবস্থা করা। দাখিলকৃত সম্পদ বিবরণী সম্পর্কে কোনো অভিযোগ আসলে তা যাচাই করা; কোনো প্রকার অসঙ্গতি পাওয়া গেলে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

১২. দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনগণের সচেতনতা ও অংশগ্রহণ বাড়ানোর জন্য স্থানীয় পর্যায়ে সামাজিক আন্দোলন জোরদার করা।

spot_img
spot_img

এই বিভাগের আরও পড়ুন

চট্টগ্রাম

সারাদেশ

বিশেষ-সংবাদ

বিনোদন