অন্তর্বর্তী সরকার পরিচালনায় ভুল-ত্রুটি থাকলে তা ধরিয়ে দিতে গণমাধ্যমকে সোচ্চার থাকার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
মঙ্গলবার (০৩ সেপ্টেম্বর) প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনায় দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমের সম্পাদকদের সঙ্গে বৈঠকে তিনি এ কথা বলেন।
স্বাধীনভাবে সংবাদ প্রকাশ করে অন্তর্বর্তী সরকারের রাষ্ট্র সংস্কারের উদ্যোগকে বেগবান করতে গণমাধ্যমের প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কার্যকর সংস্কারে সবার সহায়তা চাই।
তিনি আরও বলেন, রাষ্ট্র মেরামত করে দেশকে নতুন উচ্চতায় নিতে বড় একটি সুযোগ তৈরি হয়েছে ছাত্রজনতার আন্দোলনে। তাই সরকারের কার্যক্রমে ভুল ত্রুটি থাকলে তা গণমাধ্যমে তুলে ধরতে হবে।
পরে বৈঠক সম্পর্কে গণমাধ্যমে ব্রিফ করেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে একাত্মতা পোষণ করে সংযুক্ত আরব আমিরাতে কারাবরণ করা ৫৭ বাংলাদেশিকে ক্ষমা করেছেন দেশটির সরকার। সকালে এক বৈঠকে বিষয়টি জানান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
এরপর রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় দেশের প্রিন্ট মিডিয়ার ২০ সম্পাদকের সঙ্গে বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা। এতে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয় তাদের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার।
মতবিনিময় সভায় দেশের শীর্ষস্থানীয় পত্রিকার সম্পাদকরা অংশ নিয়েছেন। উপস্থিত সম্পাদকদের মধ্যে ছিলেন দৈনিক প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান, ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম, নিউ এজের সম্পাদক নূরুল কবির, যুগান্তরের সম্পাদক সাইফুল আলম এবং বণিক বার্তার সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদসহ অন্যান্য গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বরা।
নির্বাচন কমিশন সংস্কারসহ সরকারের উপদেষ্টাদের আরও সক্রিয় ভূমিকা রাখতে বলেছেন সম্পাদকরা বলেও জানান তিনি।
পরে যমুনার বাইরে গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে কথা বলেন সম্পাদক পরিষদের সভাপতি ও ডেইলি স্টারের সম্পাদক ও প্রকাশক মাহফুজ আনাম।
তিনি বলেন, আলোচনার মধ্যে এসেছে, আমরা চাই বাংলাদেশে একটি জাতীয় ঐক্য স্থাপিত হোক। আমরা বলেছি, আমরা এ সরকারের কাছ থেকে কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার আশা করছি। সেই সংস্কারের মধ্যে সংবিধান পরিবর্তন, স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করা, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলো—দুর্নীতি দমন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন, নির্বাচন কমিশন রিফর্ম করে সত্যিকার অর্থে গণমুখী সংস্থা এবং বিশেষত নির্বাচন কমিশন যেন ভবিষ্যতে সমস্ত নির্বাচন সত্যিকার অর্থে জাতির ও ভোটারদের চিন্তার প্রতিফলন ঘটায়, এ রকম একটা সংস্থা চাই। আমরা এ রকম একটি দুর্নীতি দমন কমিশন চাই, তারা যেন স্বাধীনভাবে কাজ করে।
মাহফুজ আনাম আরও বলেন, আরেকটি কথা বলেছি, বাসস, বিটিভি ও রেডিও, যেটা সরকারের নিয়ন্ত্রণে এদের স্বায়ত্তশাসন দেয়া হোক। পেশাগতভাবে তারা যেন তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারে।
মিডিয়া নিষ্পেশনের জন্য কালাকানুন বাতিল করার কথা বলা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট, সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট, এ ধরনের আইন, অ্যাটলিস্ট এই মুহূর্তে যেন ঘোষণা দেওয়া হয় যে, এই আইনগুলোতে সাংবাদিকদের নিপীড়নের যে ধারাগুলো আছে এগুলো কার্যকর হবে না এবং এটার রিফর্মটা ওনারা সময় নিয়ে করবেন। এখানে আরও প্রস্তাব এসেছে যে, কনস্টিটিউশনাল রিফর্ম এখানে প্রধান উপদেষ্টা যদি মনে করেন, এর জন্য একটি গ্রুপ করে দিয়ে বা কমিটি করে দিয়ে সব ধরনের আইনের পরিবর্তন জুডিশিয়ারির ইনডিপেনডেন্স, পুলিশ রিফর্ম, এগুলোর সব কিছু একটি গ্রুপের কাছে বা বিভিন্নভাবে হতে পারে। অর্থাৎ এগুলো আমরা পরিবর্তন চাই, গণতান্ত্রিক রিফর্ম চাই।’
ড. ইউনূস সম্পূর্ণ রূপে স্বাধীন সাংবাদিকতায় বিশ্বাস করেন জানিয়ে মাহফুজ আনাম বলেন, ড. ইউনূস সাংবাদিকদের বলেছেন, তিনি সম্পূর্ণরূপে স্বাধীন সাংবাদিকতায় বিশ্বাস করেন এবং আমাদের কাছে তার বিশেষ আবেদন হচ্ছে, আমরা যেন আমাদের লেখনীর মাধ্যমে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করতে পারি। তিনি আমাদের বিভিন্ন পরামর্শ সাগ্রহে গ্রহণ করেছেন এবং আমাদের আহ্বান করেছেন যে, এই সরকার পরিচালনার সব ক্ষেত্রে ভুল-ত্রুটি যেন আমরা ধরিয়ে দিই। এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেছেন, এই সরকারের ভুলত্রুটি হলে আমরা যেন নির্দ্বিধায় কাগজে ছাপি এবং এই সরকারকে সাহায্য করি।
তিনি বলেন, ‘আমি ব্যক্তিগতভাবে উপলব্ধি করছি, উনি সত্যিকার অর্থে ভাইব্র্যান্ট মিডিয়া চান। সত্যিকার অর্থে উনি গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন। মিডিয়াবান্ধব সরকারপ্রধান যদি আমরা কখনো পেয়ে থাকি, তাহলে আমরা এখন পেয়েছি। এ জন্য আমরা অত্যন্ত আনন্দিত।’
মাহফুজ আনাম বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার কতদিন থাকবে, এটা আমাদের কাছে উনি জিজ্ঞাসা করেছেন। এটা নিয়ে অনেকেই মতামত দিয়েছেন বিভিন্ন সময়। কিন্তু মূল কথা যেটা আসছে, সেটা হলো এই সরকারের এজেন্ডা কী? সেই অনুপাতে সময়। অনেক রাজনৈতিক দল বলেছে আপনাদের যতদিন লাগে, কোনো কোনো রাজনৈতিক দল বলেছে যৌক্তিক সময়, এগুলো তো অস্পষ্ট। উনার ইচ্ছা যে, আমরা খবর কাগজ-টেলিভিশনের মাধ্যমে এগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করে উনাকে একটি ধারণা দিই যে, জাতি কী চায়, কত বছর হতে পারে দুই-তিন-পাঁচ বছর। এটা নিয়ে উনার নিজস্ব কোনো চিন্তা নেই, উনি চান জনতার চিন্তা জানতে। সে ব্যাপারে উনি মিডিয়াকে আহ্বান করেছেন, আমরা যেন জনগণের কথা লিখি এবং উনাকে জানাই যে কত দিন।’
তিনি বলেন, ‘উনার ধারণা হচ্ছে, পৃথিবী এখন আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। তারা অনেক উৎসুক এই পরিবর্তনে এবং তারা চায় বাংলাদেশকে তারা যেভাবে পারে সাহায্য করতে। এটা আমাদের জন্য একটি বড় সৌভাগ্য।’