Google search engine
প্রচ্ছদচট্টগ্রামচট্টগ্রামে বাসে চালক-সহকারীর তথ্য টাঙানো বাস্তবায়ন হয়নি ৬ বছরেও

চট্টগ্রামে বাসে চালক-সহকারীর তথ্য টাঙানো বাস্তবায়ন হয়নি ৬ বছরেও

প্রায় ৬০ লাখ মানুষের বাস চট্টগ্রাম মহানগরীতে। নগরীতে চলাচল করে প্রায় সাড়ে তিন লাখ যান্ত্রিক যানবাহন। পাশাপাশি আছে তিন লাখের বেশি প্যাডেলচালিত রিকশা। এসব যানবাহন নিয়ন্ত্রণে হিমশিম চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ। নগরীজুড়ে যত্রতত্র পার্কিং, ট্রাফিক নির্দেশনা না মানা, অবৈধ যানবাহন চলাচল করার কারণে অব্যবস্থাপনা দেখা দিয়েছে নগর ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায়। দুর্ঘটনা, প্রতারণা কিংবা যানজটে নাকাল হয়ে যার মাশুল গুনতে হচ্ছে নগরবাসীকেই। নগর ট্রাফিকের অব্যবস্থাপনা নিয়ে নিজস্ব প্রতিবেদক ইকবাল হোসেনের ছয় পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ থাকছে তৃতীয়টি।

ছয় বছর পার হতে চললেও গণপরিবহনে চালক-সহকারীর নাম, ছবি, লাইসেন্স ও মোবাইল নম্বর সম্বলিত তালিকা টাঙানোর বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের নির্দেশনার বাস্তবায়ন নেই চট্টগ্রামে। অনেক চালক-সহকারী এ বিষয়ে জানেনই না। কেউ আবার বাস্তবায়ন হলে ভালো হবে বলেই মনে করেন। যদিও এ নির্দেশনা বাস্তবায়নে কার্যকর কোনো পদক্ষেপই নেই নগর ট্রাফিক ও বিআরটিএর।

জানা যায়, ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই রাজধানী ঢাকার কুর্মিটোলায় বাসচাপায় দুই শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার পর সারাদেশে নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করে। শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলন সামাল দিতে ট্রাফিক সপ্তাহ ঘোষণা দিয়ে পুলিশ সারাদেশে সাঁড়াশি অভিযান শুরু করে। পুলিশের পাশাপাশি সারাদেশের উপজেলা পর্যায়ে স্থানীয় প্রশাসনও সড়ক-মহাসড়কে চেকপোস্ট বসিয়ে অভিযান চালায়। ওই সময়ে পরিবহনের নানা ডকুমেন্ট হালনাগাদ করার পাশাপাশি গাড়ির ফিটনেস ও ড্রাইভিং লাইসেন্স সংগ্রহের জন্য বিআরটিএমুখী হন গাড়ির চালক-মালিকরা। পরবর্তীসময়ে এ আগ্রহে ভাটা পড়ে।

বেপরোয়া যান চালনাকারী চালকদের নিয়ন্ত্রণে আনতে গণপরিবহনে বিশেষ করে বাসে চালক-সহকারীর নাম, ছবি, লাইসেন্স ও মোবাইল নম্বর সম্বলিত তালিকা টাঙানোর বিষয়ে নির্দেশনা জারি করে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়। এরপর বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ওই নির্দেশনা বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নেয়।

পরবর্তীসময়ে চট্টগ্রামেও এ নির্দেশনা বাস্তবায়নের জন্য বিআরটিএ সদর কার্যালয় থেকে ২০১৮ সালের ২৮ আগস্ট চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ে চিঠি দেয়। এর ছয় বছর পার হতে চললেও চট্টগ্রামে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের সেই নির্দেশনা কার্যকরে ফলপ্রসূ কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

গণপরিবহনে বিশেষ করে যাত্রীবাহী বাসে চালক-হেলপারের ছবি, নাম-পরিচয় এবং মোবাইল নম্বর সম্বলিত তালিকা টাঙানোর জন্য প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের একটি নির্দেশনা রয়েছে। এ নির্দেশনা বাস্তবায়ন করবেন গাড়ির মালিকরা। আমরা বিভিন্ন সময়ে বৈঠকে বাস মালিকদের এ বিষয়ে অনুরোধ করেছি।- সিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) প্রকৌশলী আবদুল মান্নান মিয়া

সরেজমিনে নগরীর বেশ কয়েক স্থানে গণপরিবহন চালক ও সহাকারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ছবি, লাইসেন্স নম্বর, মোবাইল নম্বর সম্বলিত তালিকা টাঙানোর বিষয়ে প্রশাসনের কেউ কোনোদিন জানতেও চাননি তাদের কাছে।

চট্টগ্রাম মহানগরীর নিউ মার্কেট থেকে হাটহাজারীতে সরাসরি চলাচল করে দ্রুতযান স্পেশাল সার্ভিস। ওই রুটের চট্টমেট্রো-জ-১১-২১৭৬ নম্বর বাসের চালক মোশারফ হোসেন বলেন, ‘আমি ১০ বছর হেলপারি (চালকের সহকারী) করেছি। গত দেড় বছর বাস চালাই। কখনো চালক-হেলপারের ছবি টাঙানো হয়নি। তবে বিআরটিএ আমাদের সে বিষয়ে ট্রেনিং দিয়েছে। গাড়িতে ছবি টাঙানো থাকলে সুবিধা।’

১ নম্বর রুটে নিউ মার্কেট-আন্দরকিল্লা-কালুরঘাটে চলাচলকারী ‘চট্টমেট্রো-ছ-১১-১৯৪৯’ নম্বরধারী হিউম্যান হলারের চালক মো. করিম বলেন, ‘গাড়িতে যে চালক-হেলপারের ছবি টাঙাতে হয়, সে বিষয়টি আমাদের কেউ কখনো বলেনি। পুলিশও কখনো এ বিষয়ে আমাদের কাছ থেকে জানতে চায় না।’

নগরীর ৩ নম্বর রুটে (নিউ মার্কেট-অক্সিজেন-ফতেয়াবাদ) ‘চট্টমেট্রো-ছ-১১-২১৩৪’ নম্বরের হিউম্যান হলারটি চলাচল করে। দেখা গেলো গাড়িটির কোথাও সেই তালিকা নেই। কোতোয়ালি মোড়ে কথা হলে চালক মো. সুমন বলেন, ‘ছবিসহ তালিকা টাঙানোর কথা কখনো শুনিনি। বিষয়টি কেউ কোনোদিন চেকও করেননি।’

নিউ মার্কেট এলাকায় যাত্রী নিচ্ছিলেন ৭ নম্বর রুটে (কোতোয়ালি মোড়-আগ্রাবাদ-অলংকার-ভাটিয়ারি) চলাচলকারী লুসাই পরিবহনের ‘চট্টমেট্রো-জ-১১-১৮৭১’ নম্বর বাসটি। এসময় কথা হলে চালক মো. জুয়েল বলেন, ‘আমি ২০০৮ সালে লাইসেন্স করেছি। চালক-হেলপারের ছবি, মোবাইল নম্বরসহ তালিকা ঝোলানোর কথা আমরা শুনিনি। চট্টগ্রামে কোনো গাড়িতেই এ ধরনের তালিকা নেই।’

সিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) প্রকৌশলী আবদুল মান্নান মিয়া বলেন, ‘গণপরিবহনে বিশেষ করে যাত্রীবাহী বাসে চালক-হেলপারের ছবি, নাম-পরিচয় এবং মোবাইল নম্বর সম্বলিত তালিকা টাঙানোর জন্য প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের একটি নির্দেশনা রয়েছে। এ নির্দেশনা বাস্তবায়ন করবেন গাড়ির মালিকরা। আমরা বিভিন্ন সময়ে বৈঠকে বাস মালিকদের এ বিষয়ে অনুরোধ করেছি।’

গণপরিবহনগুলোতে কোনো পার্মানেন্ট (স্থায়ী) চালক নেই। আজ একজন চালালে একই গাড়ি পরের দিন আরেকজন চালায়। যে কারণে ছবিসহ তালিকা টাঙানো নিয়ে ঝামেলা পোহাতে হয়। সেজন্য ছবিসহ আইডি কার্ড গলায় ঝোলানোর জন্য আমরা চালকদের নির্দেশ দিয়েছি।- চট্টগ্রাম জেলা সড়ক পরিবহন মালিক গ্রুপের মহাসচিব মাহবুবুল আলম মিয়া

তিনি বলেন, ‘এই তালিকা গাড়িতে টাঙানো থাকলে যাত্রী ভোগান্তি কমবে। যাত্রীরা হয়রানির শিকার হলে ওই চালক-হেলপারের বিরুদ্ধে সহজে পুলিশের কাছে অভিযোগ করতে পারবেন। তাছাড়া কোনো চালক দুর্ঘটনা ঘটিয়ে পালিয়ে গেলেও তাকে সহজে আইনের আওতায় আনা সম্ভব হবে।’

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কমিটির সভাপতি মো. মুছা বলেন, ‘২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের নির্দেশনা ছিল গণপরিবহনের বিশেষ করে বাসে চালক-হেলপারের ছবি টাঙানো। আবার ওই বছরের সড়ক পরিবহন আইনেও চালকদের আট ঘণ্টা গাড়ি চালানোর বিষয়ে সময় নির্ধারণ করে দেওয়া আছে। কিন্তু মালিকরা বিষয়টি মানছেন না। ট্রাফিক বিভাগ, বিআরটিএ, মালিক ও শ্রমিকপক্ষ যৌথভাবে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা উচিত।’

চট্টগ্রাম জেলা সড়ক পরিবহন মালিক গ্রুপের মহাসচিব মাহবুবুল আলম মিয়া বলেন, ‘গণপরিবহনগুলোতে কোনো পার্মানেন্ট (স্থায়ী) চালক নেই। আজ একজন চালালে একই গাড়ি পরের দিন আরেকজন চালায়। যে কারণে ছবিসহ তালিকা টাঙানো নিয়ে ঝামেলা পোহাতে হয়। সেজন্য ছবিসহ আইডি কার্ড গলায় ঝোলানোর জন্য আমরা চালকদের নির্দেশ দিয়েছি।’

তিনি বলেন, ‘দেশে অনেক চালক আছে, যাদের এখনো ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। আমরা দীর্ঘদিন থেকে দাবি জানিয়ে আসছিলাম, প্রশিক্ষিত পুরোনো চালকদের পরীক্ষা ছাড়াই তাৎক্ষণিক লাইসেন্স দেওয়ার জন্য। কিন্তু তা কার্যকর হয়নি। উপরন্তু বর্তমানে চালকের লাইসেন্স নিতে অষ্টম শ্রেণি পাস সনদ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এতে গণপরিবহনের চালকদের লাইসেন্স পাওয়া বিলম্বিত হচ্ছে।’

বিআরটিএ চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক মো. শফিকুজ্জামান ভূঁঞা বলেন, ‘গণপরিবহনে চালকের ছবি সম্বলিত তালিকা দর্শনীয় স্থানে টাঙানোর বিষয়ে আমরা পরিবহন মালিকদের সঙ্গে বিগত সময়ে অনেকবার বৈঠক করেছি। চালকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার সময় আমরা বিষয়টি সম্পর্কে সচেতনতা তৈরির চেষ্টা করি।’

‘আমরা পরিবহন মালিকদের অনুরোধ করেছি নির্দেশনা অনুযায়ী চালক-হেলপারদের ছবি সম্বলিত তালিকা গাড়ির দুটি দর্শনীয় স্থানে টাঙানোর পদক্ষেপ নিতে। আর যেসব গাড়ি ফিটনেস হালনাগাদ করার জন্য আমাদের কার্যালয়ে আসছে, সেগুলোতে আমরা তালিকা টাঙানোর বিষয়টি নিশ্চিত করছি। তবে কেউ এই তালিকা না টাঙালে সামনে থেকে আমাদের মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে পদক্ষেপ নেবো।’

spot_img
spot_img

এই বিভাগের আরও পড়ুন

চট্টগ্রাম

সারাদেশ

বিশেষ-সংবাদ

বিনোদন