দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সারা দেশের ভোটকেন্দ্র পুনর্গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এরই অংশ হিসেবে নিরাপত্তা ও ভোটের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে পুরোনো কেন্দ্রগুলো কাটছাঁট বা স্থানান্তর করার কাজে হাত দিয়েছে নির্বাচন পরিচালনাকারী সাংবিধানিক এ প্রতিষ্ঠান।
ভোটকেন্দ্র ঢেলে সাজাতে ইতোমধ্যেই কেন্দ্রের স্থান নির্ধারণে পুলিশ ও প্রশাসনকে যুক্ত করে নতুন নীতিমালা অনুমোদন দিয়েছে ইসি। এই নীতিমালা পরিপত্র আকারে জারি করতে নীতিমালার খুঁটিনাটি যাচাই করা হচ্ছে।
যদিও একাদশ জাতীয় নির্বাচনে সারা দেশে ৪০ হাজার ১৯৯টি কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ করা হয়।
ইসি বলছে, যেসব স্থাপনা ভোটকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছিল, এর অনেকগুলো পুরোনো বা নষ্ট হয়ে গেছে। আশপাশে নতুন স্থাপনা হয়েছে। সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে এবার নতুন করে ভোটকেন্দ্র স্থাপন করা হবে।
যদিও এতদিন ভোটকেন্দ্র স্থাপনের স্থান এককভাবে ইসি নির্ধারণ করতো। তবে নতুন নীতিমালা কার্যকর হলে পুলিশ ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা স্ব স্ব দায়িত্বপূর্ণ এলাকায় ভোটকেন্দ্র নির্ধারণে প্রতিনিধিত্ব করার ক্ষমতা পাচ্ছেন।
নতুন খসড়া নীতিমালা অনুযায়ী, দুটি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে দূরত্ব তিন কিলোমিটারের বেশি হতে পারবে না। প্রার্থীর প্রভাবাধীন স্থাপনায় ভোটকেন্দ্র স্থাপন করা যাবে না। যেসব ব্যক্তি রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত বা নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার সম্ভাবনা আছে, তাদের নামে স্থাপিত প্রতিষ্ঠানে ভোটকেন্দ্র স্থাপন এড়ানো বা বিরত থাকার চেষ্টা করতে হবে।
নতুন নীতিমালায় ভোটকেন্দ্র নির্ধারণে গঠিত কমিটিতে প্রতিনিধিত্ব করার ক্ষমতা পাচ্ছেন জেলা প্রশাসক (ডিসি), উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও), পুলিশ সুপার, শিক্ষা কর্মকর্তা, থানার অফিসার ইনচার্জ ও মহানগরের ক্ষেত্রে পুলিশ কমিশনারের প্রতিনিধি। তবে কমিটি ভোটকেন্দ্রের খসড়া তালিকা করবেন, যা চূড়ান্ত করবেন রিটার্নিং অফিসার। এসব কমিটির সদস্যসচিব থাকবেন নির্বাচন কর্মকর্তারা।
শিক্ষা কর্মকর্তা ও পুলিশ কর্মকর্তাদের যুক্ত করার বিষয়ে নতুন নীতিমালায় বলা হয়েছে, শিক্ষা কর্মকর্তারা আওতাধীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামোগত অবস্থা, কক্ষের সংখ্যা, যাতায়াতব্যবস্থা সম্পর্কে বিশেষভাবে অবগত থাকেন। অন্যদিকে পুলিশ কর্মকর্তারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ অন্যান্য স্থাপনার যাতায়াতব্যবস্থা ও সার্বিক নিরাপত্তাব্যবস্থা সম্পর্কে অবগত থাকেন।
ভোটকেন্দ্র স্থাপনে কিছু বিষয় বিবেচনায় নেওয়ার কথা বলা আছে নতুন নীতিমালায়। যেগুলো আগের নীতিমালায়ও ছিল। বলা হয়েছে, ভোটারদের যাতায়াত সুবিধা ও ভৌগোলিক অবস্থান বিবেচনা করে ভোটকেন্দ্র স্থাপন করতে হবে। ভোটার অবস্থানের বা বসবাসকারী এলাকাগুলো যেন ভোটকেন্দ্র সংলগ্ন ও সুনিবিড় হয়।
তবে পুলিশ-প্রশাসনকে যুক্ত করে ভোটকেন্দ্র ঢেলে সাজানোকে সহজভাবে দেখছেন না সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার। তিনি ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন যতই ইতিবাচকভাবে এ নীতিমালা উপস্থাপন করুক না কেন, এর নেতিবাচক দিকও রয়েছে।’
পুলিশ ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ভোট প্রভাবিত করার অভিযোগ থাকার বিষয়টি উল্লেখ করে সুজন সম্পাদক বলেন, ইসি নিজস্ব কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়ার ক্ষমতা সংরক্ষণ করে। সে ক্ষেত্রে তাদের (পুলিশ-প্রশাসন) যুক্ত কেন করতে হবে- সন্দেহটা এই জায়গাতেই।
‘এছাড়া পুলিশ ও প্রশাসন যদি বিশেষ প্রার্থীর কথা মাথায় রেখে ভোটকেন্দ্র নির্ধারণ করে, তাহলে সুষ্ঠু ভোট বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যায়’, বলেন ড. বদিউল।
তবে এ প্রক্রিয়াকে ভোটকেন্দ্র নির্ধারণের সমন্বয় হিসেবে দেখছেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন। তিনি বলেন, ‘ভোটকেন্দ্রের স্থান একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নীতিমালা অনুযায়ী সততার সঙ্গে কাজ করলে সমন্বিতভাবে ভোটকেন্দ্র নির্ধারণে আপত্তির কিছু নেই। তবে নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ নির্ভর করে নির্বাচন কমিশনের ওপর। নির্বাচনকালীন সময়ে কমিশন চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী থাকেন। তারা নিরপেক্ষ হলে নির্বাচন নিরপেক্ষ হবে। আর তারা প্রভাবিত হলে নির্বাচন প্রভাবিত হবে।’
ইসি সূত্র জানায়, গত বৃহস্পতিবার নির্বাচন কমিশনের বৈঠকে ‘জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটকেন্দ্র স্থাপন এবং ব্যবস্থাপনা নীতিমালা’ অনুমোদন করা হয়। এ নীতিমালায় পুলিশ ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে পাওয়া প্রস্তাবকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা বেশি হওয়ায় ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তা নিশ্চিতে চাহিদা মতো জনবল নিয়োগ করতে পুলিশকে বেগ পেতে হয়। কেন্দ্রে পর্যাপ্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করতে না পারায় ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তা দুর্বল হয়ে পড়ে বলে এক বৈঠকে পুলিশের পক্ষ থেকে ইসিকে জানানো হয়। এরপর ভোটকেন্দ্র স্থাপন নীতিমালায় পরিবর্তন আনার কথা ভাবতে শুরু করে ইসি। ওই প্রস্তাব বিবেচনায় নিয়ে ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা কমানোর বিষয়ে ভাবা হচ্ছে।
তবে পুলিশ ও প্রশাসনকে যুক্ত করলেও ভোটকেন্দ্র নির্ধারণের চূড়ান্ত ক্ষমতা ইসির হাতেই থাকছে। এতে ইসির ক্ষমতা খর্ব হওয়ার আশঙ্কা দেখছে না কমিশন।
জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা সরকার ও নির্বাচন কমিশনের নানা কার্যক্রমে মুখ্য সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করেন। তাই সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে কমিটি গঠন করে তাদের মতামতের ভিত্তিতে ভোটকেন্দ্র স্থাপনের কাজ অধিকতর সহজ ও সুষ্ঠু হবে বলে মনে করে ইসি।
ইসির একজন কমিশনার পদমর্যাদার কর্মকর্তা বলেন, মূলত আগে ভোটকেন্দ্র নির্বাচনের কাজটি ইসি একাই করতো। নতুন নীতিমালায় কিছুটা পরিবর্তন আনা হয়েছে। নির্বাচন পরিচালনা ও শৃঙ্খলা রক্ষাসহ সার্বিক দায়িত্বে সরকারের যে সংস্থাগুলো কাজ করে তাদের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে ভোটকেন্দ্র নির্ধারণের কথাই বলা হয়েছে নতুন নীতিমালায়। যাতে কেউ প্রভাবিত হয়ে ইচ্ছামাফিক কোথাও ভোটকেন্দ্র স্থাপন করতে না পারে।
ইসি কর্মকর্তারা জানান, গেল বছর অক্টোবরে দেশের সব জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও পুলিশ সুপারদের (এসপি) সঙ্গে মতবিনিময় করে কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন কমিশন। ওই সভায় পুলিশের পক্ষ থেকে ভোটকেন্দ্রের স্থান নির্ধারণের কাজে তাদের যুক্ত করার প্রস্তাব আসে। ভোটকেন্দ্র কমানোর বিষয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশনের ওই বৈঠকে বলা হয়, ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা কমালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা তুলনামূলক সহজ হবে। ভোটকেন্দ্রে আগের চেয়ে বেশিসংখ্যক জনবল মোতায়েন করা যাবে।
যেভাবে নির্ধারণ হবে ভোটকেন্দ্র
ইসির নতুন নীতিমালায় বলা হয়েছে, উপজেলা পর্যায়ে সম্ভাব্য ভোটকেন্দ্রের তালিকা তৈরির জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি থাকবে। সদস্যসচিব হবেন উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা। সদস্য হিসেবে থাকবেন সংশ্লিষ্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি), উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ও উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা। কমিটি ভোটকেন্দ্রের খসড়া তালিকা তৈরি করার পর রিটার্নিং কর্মকর্তা চূড়ান্ত করবেন।
আর জেলা পর্যায়ে ডিসির নেতৃত্বে সাত সদস্যের কমিটি থাকবে।
মহানগর বা জেলায় ভোটকেন্দ্র স্থাপন কমিটিতে সদস্যসচিব হবেন জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা। সদস্য থাকবেন বিভাগীয় কমিশনারের প্রতিনিধি (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে), পুলিশ সুপার, সংশ্লিষ্ট মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারের প্রতিনিধি, জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ও জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা।
উপজেলা কমিটির তৈরি করা ভোটকেন্দ্রের প্রস্তাবিত তালিকা মহানগর বা জেলা কমিটিতে পাঠাতে হবে। এই কমিটি ভোটকেন্দ্র সরেজমিন তদন্ত করে মতামত দেবে। এই মতামতসহ খসড়া তালিকা নির্বাচন কমিশনে পাঠাবেন জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা। এরপর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবে কমিশন।