সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফেরাতে বিএনপির পক্ষ থেকে রিভিউ (পুনর্বিবেচনা) দায়ের করেছেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
গতকাল বুধবার (১৬ অক্টোবর) সন্ধ্যায় সুপ্রিম কোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় এই রিভিউ দায়ের করেন তিনি। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির।
তিনি জানান, এ ব্যাপারে আজ বৃহস্পতিবার (১৭ অক্টোবর) দুপুর সোয়া ১টায় সুপ্রিম কোর্ট বার অডিটোরিয়ামে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের কেন্দ্রীয় সভাপতি জয়নাল আবেদীন বিস্তারিত জানাবেন।
এর আগে ২০১১ সালের ১০ মে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনে করা সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে তা বাতিল করেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। তবে পরবর্তী দশম ও ১১তম নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করা যেতে পারে বলে মত দেন আদালত। আর এক্ষেত্রে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনে সংসদে ঐকমত্যের ভিত্তিতে যেকোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে বলেও জানিয়েছিলেন আদালত। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ এ রায় দেন।
আদালত তার রায়ে বলেন, আপিল বিভাগের সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতেই আবেদনটি গৃহীত হয়েছে। এর মাধ্যমে সংবিধান (ত্রয়োদশ সংশোধনী) আইন ১৯৯৬ এই নির্দেশের পর থেকে অবৈধ ও সংবিধান-বহির্ভূত ঘোষণা করা হলো। তবে আইনসম্মত না হলেও (প্রয়োজনের কারণে আইনসম্মত এবং জনগণের নিরাপত্তাই সর্বোচ্চ আইন, রাষ্ট্রের নিরাপত্তাই সর্বোচ্চ আইন, সুপ্রাচীনকাল ধরে চলে আসা নীতিমালার ভিত্তিতে) আগামী দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বাতিল করা ত্রয়োদশ সংশোধনীর আওতায়ই হতে পারে।
এ সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতিদের মধ্য থেকে অথবা আপিল বিভাগের বিচারপতিদের মধ্য থেকে একজনকে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার বিধানটি বাতিল করার পূর্ণ স্বাধীনতাও সংসদের থাকবে। একইসঙ্গে ২০০৫ সালে এ প্রসঙ্গে দায়ের করা লিভ টু আপিলটিও খারিজ করা হলো বলে জানান আদালত। ২০১১ সালে ৬ এপ্রিল এ আপিলের ওপর শুনানি গ্রহণ শেষে বিষয়টি রায়ের জন্য অপেক্ষমান (সিএভি) রাখেন আপিল বিভাগ।
রায় ঘোষণার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় মামলার অন্যতম পিটিশনার আবদুল মান্নান খান বলেন, আপিল বিভাগের এই আদেশের ফলে দেশের গণতন্ত্রের ভিত আরও সুদৃঢ় হবে এবং বিচার বিভাগ আরও বেশি প্রভাবমুক্ত থাকতে পারবে।
আপিলকারীর আইনজীবী এমআই ফারুকী বলেন, আপিল বিভাগে এ রায়ের ফলে আমরা সংবিধান রক্ষা করতে পেরেছি। এটি সংবিধান, গণতন্ত্র ও জাতির জন্য খুবই ভালো হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা হলো সামরিক শাসনের আরেকটি রূপ। সামরিক শাসন আমলে যেমন সংবিধানের কিছু ধারা রহিত ও অকার্যকর রাখা হয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও তা করা হয়।
বিশিষ্ট আইনজীবী ও এ মামলার আমিকাস কিউরি ড. এম জহির বলেন, সুন্দর রায় হয়েছে, আমি দীর্ঘদিন বলেছি, বিচারকদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রক্রিয়া থেকে দূরে রাখতে। এ রায়ে আমার কথাই অনেকটা প্রতিফলিত হয়েছে। এ রায় অনুযায়ী আগামী দশম ও একাদশ নির্বাচন হবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আওতায়। কিন্তু বিচারকদের না জড়ানোর জন্য সংসদ সংশোধনী আনতে পারবে বলে রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে।
তবে গত ২৫ আগস্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল সংক্রান্ত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করা বাতিলের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ (পুনর্বিবেচনা) আবেদন করেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ ব্যক্তি। বাকিরা হলেন- তোফায়েল আহমেদ, এম হাফিজ উদ্দিন খান, জোবাইরুল হক ভূঁইয়া ও জাহরা রহমান। তাদের পক্ষে অ্যাডভোকেট শরীফ ভূঁইয়া ও ব্যারিস্টার তানিম হোসেন শাওন রিভিউ আবেদন করেন।
প্রসঙ্গত, ১৯৯৬ সালে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে যোগ হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা। এরপর থেকে নির্বাচিত সরকারের মেয়াদ শেষে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়ে পরবর্তী সরকার গঠিত হচ্ছিল। ২০০৪ সালে ত্রয়োদশ সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে অ্যাডভোকেট এম সলিম উল্লাহসহ কয়েকজন আইনজীবী রিট করেন। সে সময় হাইকোর্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে বৈধ বলে ঘোষণা করে রায় দিয়েছিল।
এরপর ২০০৫ সালে এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন অ্যাডভোকেট সলিম উল্লাহ। দীর্ঘ বিরতির পর গত ১ মার্চ শুনানি শুরু হয়। আদালত এ মামলায় আট জন আমিকাস কিউরি (আদালতের বন্ধু) নিয়োগ করে তাদের মতামত শোনেন। এদের মধ্যে পাঁচ জন সরাসরি তত্ত্বাবধায়ক সরকার-ব্যবস্থার পক্ষে মত দেন। এরা হলেন— ড. কামাল হোসেন, টিএইচ খান, সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল মাহমুদুল ইসলাম, ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম ও ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ।
অপর অ্যামিকাস কিউরি ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কিউসি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পক্ষে মত দেন। ব্যারিস্টার রফিক-উল-হক ও ড. এম জহির তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার আমূল সংস্কারের পক্ষে মত দিয়ে তাদের প্রস্তাব আদালতে তুলে ধরেন। এছাড়া তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখার পক্ষে মত দেন।