চট্টগ্রামের পাঁচলাইশের হামজারবাগে রহমানিয়া উচ্চ বিদ্যালয়। ঐতিহ্যবাহী এই শিক্ষাঙ্গন আজ পরিণত হয়েছে সাবেক কাউন্সিলর মোবারক আলী ও তার সিন্ডিকেটের লুটপাটের স্বর্গরাজ্যে। স্কুলের জমি দখল করে অবৈধভাবে দোকান নির্মাণ, নামমাত্র মূল্যে বরাদ্দ, আর সেই ভাড়াও পরিশোধ না করার এক অভিনব ‘সফল’ ব্যবসা ফেঁদে বসেছেন মোবারক আলী।
২০১৩ সাল। রহমানিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের সীমানা দেওয়াল ভেঙে, যেন পৈতৃক সম্পত্তি, চট্টগ্রাম-হাটহাজারী সড়কের পাশে ১৩টি দোকান নির্মাণ করে মোবারক আলী ও তার সিন্ডিকেট। স্কুলের সাথে ৯টি এবং স্কুলে প্রবেশের রাস্তার পাশে আরও ৪টি – মোট ১৩টি দোকান। কাজী ফার্মস, পল্লী মঙ্গল ফার্মেসি, মাহি এন্টারপ্রাইজ, গাউসিয়া ফল বিতান, মধুবন, বাটার শোরুম, আরাফাত ট্রেডিং করপোরেশন, আজমীর এন্টারপ্রাইজ, এবং এস আর ট্রেডার্স – এই দোকানগুলোর মালিক কারা?
আওয়ামী লীগ নেতাদের যোগসাজশে নামমাত্র সালামি ও মাসিক ভাড়ায় দোকানগুলো বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, এই নামমাত্র ভাড়াও বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে পরিশোধ করছেন না দোকান মালিকরা।
মোবারক আলী তার স্ত্রী নুর-এ-শামসুন নেছার নামে ‘শামস মনি ফুডস কর্ণার’ নামক দোকানের মালিক পরিচয়ে একটি দোকান বরাদ্দ নেন। ১২০ বর্গফুটের দোকানের জন্য মাত্র ৪ লাখ টাকা সালামি (জামানত) ও মাসিক ভাড়া মাত্র আড়াই হাজার টাকা! অথচ সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা গেছে, দোকানটির আয়তন ৩০০ বর্গফুটের কাছাকাছি! শহরের প্রাণকেন্দ্রে, ব্যস্ত সড়কের পাশে, প্রশস্ত ফুটপাতের পাশে অবস্থিত দোকানটির ভাড়া হওয়ার কথা ৩০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা বা তারও বেশি। ‘ফুড কর্ণার’ থেকে রাতারাতি ‘ফার্মেসি’ – কাজী ফার্মস এবং পল্লী মঙ্গল ফার্মেসী স্থাপন করে সেখানেই চুটিয়ে ব্যবসা করছেন মোবারক আলী।
এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, সরকারি জমি দখল, ক্ষমতার অপব্যবহার করে অর্থ উপার্জন – মোবারক আলীর বিরুদ্ধে রয়েছে অসংখ্য অভিযোগ। দুদক তার বিরুদ্ধে তদন্ত করছে। টেকনাফে বন্দুকযুদ্ধে নিহত এক রোহিঙ্গা ডাকাতকে স্থানীয় বাসিন্দা উল্লেখ করে সনদ দেয়া এবং ওই সনদে জাতীয় পরিচয়পত্র পাইয়ে দেয়ার অভিযোগও আছে তার বিরুদ্ধে।এখানেই শেষ নয়, মোবারক আলীর বিরুদ্ধে রয়েছে এক স্কুলছাত্র হত্যা মামলা।
মোবারক আলীর এই লুটপাটের সঙ্গী নগরের ৭নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক এসকান্দার মিয়ার নেতৃত্বাধীন স্কুল পরিচালনা কমিটি। ১২ বছর ধরে সভাপতি থাকা এসকান্দার মিয়ার সাথে কমিটিতে ছিলেন ৭নং ওয়ার্ড যুবলীগের সাবেক সভাপতি দেলোয়ার হোসেন বাবুল, ৭ নং ওয়ার্ড যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মো. আজিজ, ইউনিট আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি মো. নাসির প্রকাশ লোহা নাসির, এবং নারী সদস্য শাহনাজ বেগম তামান্না। নতুন বিজ্ঞান ভবন নির্মাণ বাবদ এই কমিটি প্রধান শিক্ষকের সাথে যোগসাজশে প্রায় সাড়ে চার কোটি টাকা উত্তোলন করে নিলেও, বাস্তবে খরচ হয়েছে আড়াই থেকে তিন কোটি টাকা।
মোবারক আলীর স্ত্রী নুর-এ-শামসুন নেছাকে দোকান ভাড়া দেওয়ার চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেন সেই সময়ের প্রধান শিক্ষক আবু তৈয়ব আশরাফী। চাপের মুখে চুক্তিপত্রে সই করতে বাধ্য হয়েছেন বলে পরবর্তীতে স্বীকার করেন তিনি। দুর্নীতির দায়ে পরবর্তীতে তাকে চাকরিচ্যুত করে তালেব আলী নেতৃত্বাধীন এডহক কমিটি। তালেব আলী? হ্যাঁ, **মোবারক আলীর সৎ ভাই!
অবৈধভাবে দোকান তৈরি ও দোকান বরাদ্দে অনিয়মের বিষয়টি স্বীকার করলেও, ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক জেবুন নিছা খানম দোকানগুলো উচ্ছেদ বা বরাদ্দ বাতিলের বিষয়ে কোনও ব্যবস্থা নেননি। “দোকানগুলোর ভাড়া অনেক মাস ধরে বকেয়া রয়েছে। এখন উচ্ছেদ করলে বকেয়া টাকা ফেরত পেতে সমস্যা হবে।” – এই অজুহাতে তিনি চোখ বন্ধ করে রেখেছেন।
আরাফাত ট্রেডিং-এর মালিক নুরুল হুদা মোল্লা স্পষ্টতই স্বীকার করেছেন যে তিনি দোকানটি অন্য একজনের কাছ থেকে ভাড়া নিয়েছেন। ভাড়া পরিশোধ করছেন না কেন? “স্কুলে কমিটি না থাকায় ভাড়া দিচ্ছি না।” ভাড়া এত কম কেন? “২৪০০ টাকাও তো আমার উঠে না।”
নুরুল হুদা মোল্লা দোকান বরাদ্দের ক্ষেত্রে ব্যাপক ঘুষ লেনদেনের ইঙ্গিত দিয়ে বলেন, “৪ লাখ টাকা ক্যাশ নিয়ে গেছে। এক লাখ টাকা কমিটি খেয়েছে। ৭ লাখ টাকার বেশি গেছে। … আরও দেওয়া লাগছে।”
রহমানিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের এই ঘটনা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, স্থানীয় প্রভাবশালী, বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং প্রশাসনের একাংশের যোগসাজশে কীভাবে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করা হয়েছে।
একজন শিক্ষার্থীর অভিভাবক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “আওয়ামী লীগের সাবেক কাউন্সিলর মোবারক আলী, দলটির নেতা এসকান্দার মিয়াসহ আরও কিছু নেতা মিলে বিদ্যালয়টিকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বানিয়ে ফেলেছে। সড়ক থেকে দেখলে স্কুলটাকে এখন একটা মার্কেট মনে হয়। অবৈধভাবে দোকান তৈরির ফলে রাস্তার পাশে ফুটপাত ছোট হয়ে গেছে। এসব বিষয়ে কর্তৃপক্ষের নজর দেওয়া উচিত।”
চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) মো. শরীফ উদ্দিন বলেছেন, “রহমানিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের এই বিষয়টি নিয়ে কেউ লিখিত অভিযোগ করলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
প্রশ্ন হচ্ছে, লিখিত অভিযোগের অপেক্ষা না করে কর্তৃপক্ষ কি নিজ উদ্যোগে এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে না? মোবারক আলী ও তার সিন্ডিকেটের হাত থেকে রহমানিয়া উচ্চ বিদ্যালয়কে মুক্ত করে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব কি প্রশাসনের নয়?